Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

‘ছেলেকে ফেলে দেয়নি তো’

উচ্চ মাধ্যমিক শুরুর আগে প্রণাম করে তাঁর আশীর্বাদ নিতে বাড়ি থেকে ছুটে এসেছিলেন ছাত্রটি। সঙ্গে ছিল অঙ্ক নিয়ে শেষবারের মতো দু’একটি জিজ্ঞাসা। প্রণাম করে তাঁর প্রিয় ছাত্রের সেই ফেরাই যে শেষ চলে যাওয়া হবে, তা কোনও ভাবেই মানতে পারছেন না জিষ্ণু মুখোপাধ্যায়ের সেই শিক্ষক।

মায়ের সঙ্গে শেষ নিজস্বী। মৃত ছাত্র জিষ্ণু মুখোপাধ্যায়ের পারিবারিক সংগ্রহ থেকে।

মায়ের সঙ্গে শেষ নিজস্বী। মৃত ছাত্র জিষ্ণু মুখোপাধ্যায়ের পারিবারিক সংগ্রহ থেকে।

নিজস্ব সংবাদদাতা
রামপুরহাট শেষ আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০১:২৪
Share: Save:

উচ্চ মাধ্যমিক শুরুর আগে প্রণাম করে তাঁর আশীর্বাদ নিতে বাড়ি থেকে ছুটে এসেছিলেন ছাত্রটি। সঙ্গে ছিল অঙ্ক নিয়ে শেষবারের মতো দু’একটি জিজ্ঞাসা। প্রণাম করে তাঁর প্রিয় ছাত্রের সেই ফেরাই যে শেষ চলে যাওয়া হবে, তা কোনও ভাবেই মানতে পারছেন না জিষ্ণু মুখোপাধ্যায়ের সেই শিক্ষক।

সাঁইথিয়া থেকে বাড়ি ফেরার পথে বর্ধমান–সাহেবগঞ্জ লুপ লাইনে মল্লারপুর ও তারাপীঠ রোড স্টেশনের মাঝে জয়রামপুর সেতু সংলগ্ন এলাকায় আপ লাইনে রামপুরহাট হাইস্কুলের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র জিষ্ণু মুখোপাধ্যায়ের (১৮) ট্রেনে কাটা দেহ উদ্ধার হয়েছে বৃহস্পতিবার গভীর রাতে। ২৪ ঘণ্টা কেটে গেলেও রামপুরহাটের চাকপাড়া গ্রামের বাসিন্দা ওই ছাত্রের মৃত্যুর কারণ নিয়ে ধন্দ কাটছে না পরিবারের। রেল পুলিশের দাবি, ট্রেন থেকে পড়েই জিষ্ণুর মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু, একটি ফাঁকা ট্রেন থেকে ওই ছাত্র কী করে পড়ে গেলেন, তার উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না তারাও।

শনিবার দুপুরে চাকপাড়ার মুখোপাধ্যায় পাড়ায় ওই ছাত্রের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল তখনও বাড়িতে শোকের ছায়া। জিষ্ণুর বাবা মলয় মুখোপাধ্যায় তারাপীঠ মন্দিরের সেবাইত। একমাত্র ছেলের এ রকম রহস্যজনক মৃত্যুকে কোনও ভাবেই মেনে নিতে পারছেন না। বাড়ির উঠোনে বসে জিষ্ণুর শোকস্তব্ধ মা মালাদেবী জানালেন, ঘটনার দিন বিকালে পাড়ার সরস্বতী পুজোর দশকর্মা বাজার করার জন্য খুড়তুতো ভাই ঋজুকে দায়িত্ব দিয়েছিল জিষ্ণু। সেই দায়িত্ব বণ্টন করেই সাঁইথিয়ায় ‘প্রকাশ স্যারে’র বাড়ি যাবে বলে ট্রেন ধরতে সাইকেল নিয়ে ছুটেছিল তারাপীঠ রোড স্টেশনে। যাওয়ার আগে মায়ের হাতে চা খেয়ে হাত নাড়িয়ে ঘর ছেড়েছিল ছেলেটি। হাসিমুখে তাঁর সেই হাত নাড়ানোই যে ছেলেকে শেষ দেখা হয়ে যাবে, তা দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি মালাদেবী। ‘‘ছেলে চিন্তা করতে বারণ করেছিল। বলেছিল, উচ্চ মাধ্যমিকে খুব ভাল ফল করবে। তার পরে আইএসআই-তে (ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট) পড়বে,’’—বলেই কেঁদে ফেললেন সদ্য সন্তান হারানো মা।

এ দিকে, আঠারো বছরের এক জ্বলজ্যান্ত ছেলের বাড়ি থেকে বের হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এমন মৃত্যুকে ঘিরে নানা জল্পনা শুরু হয়েছে গ্রামে। জিষ্ণুর মৃত্যুর খবর পেয়ে সিউড়ির শক্তিপুর থেকে ছুটে এসেছেন তাঁদের আত্মীয় দেবাশিস গঙ্গোপাধ্যায়। পেশায় মুর্শিদাবাদের কাশিমবাজার হাইস্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক দেবাশিসবাবুর কাছে এমন মৃত্যু স্বাভাবিক ঠেকছে না। তাঁর প্রশ্ন, ‘‘এক যুবক দুম করে ফাঁকা ট্রেন থেকে পড়ে যাবে? আর তা কেউ দেখতে পাবে না?’’ এই রহস্যজনক মৃত্যু নিয়ে ধন্দ কাটছে না জিষ্ণুর দাদু, মল্লারপুরের বাসিন্দা জীবন পাণ্ডারও। তাঁর বক্তব্য, জিষ্ণুর দেহ যেখানে পড়েছিল, সেখান থেকে তারাপীঠ রোড স্টেশন মাত্র দু’তিন মিনিটের পথ। এত কাছে এসে কেউ কী করে ট্রেন থেকে পড়ে যেতে পারে, তার উত্তর জীবনবাবুরা খুঁজে পাচ্ছেন না।

তবে কি কেউ জিষ্ণুকে ট্রেন থেকে ফেলে দিয়েছিল?

এমন সম্ভাবনার কথা উড়িয়ে দিচ্ছে না পরিবার। মালাদেবী অবশ্য জানাচ্ছেন, জিষ্ণু গত দু’বছর ধরে সাঁইথিয়ায় অঙ্ক ও কেমিস্ট্রি টিউশন সেরে ট্রেনে বাড়ি ফিরতেন। পড়া শেষ হয়ে যাওয়ায় গত তিন মাস থেকে আর কেমিস্ট্রি পড়তে যেত না। অঙ্কটাও শেষ হয়ে গিয়েছিল। মালাদেবীর কথায়, ‘‘বৃহস্পতিবার ছেলে বলেছিল, পরীক্ষার আগে স্যারকে একবার প্রণাম করে আসবে। আর কিছু সমস্যা আছে, সেগুলোরও সমাধান জেনে নেবে।’’ সেখান থেকে বেরিয়ে একা বাড়ির ফেরার পথে ঠিক এমন ঘটল, যার জন্য জিষ্ণুকে এ ভাবে অকালে হারাতে হল? ‘‘ছেলেটাকে কি তা হলে কেউ ঠেলে ফেলে দিল...?’’— স্বগতোক্তি মায়ের। একই রকম ভাবে ঘটনায় আঘাত পেয়েছেন সপ্তম শ্রেণি থেকে জিষ্ণুকে অঙ্কে সাহায্যে করে আসা সাঁইথিয়ার সেই শিক্ষক প্রকাশ গড়াইও। শনিবার তিনি বললেন, ‘‘জিষ্ণুকে সেই ছোট্ট থেকে চিনি। আমার কাছে একা-ই অঙ্ক দেখে নিত। পরীক্ষার জন্য আশীর্বাদ নিতে এসেছিল। সে দিনও অঙ্কের কিছু সমস্যা ওর মাথায় ঘুরছিল। প্রণাম করেই স্টেশনে ট্রেন ধরতে গিয়েছিল। সেই যাওয়াই যে শেষ যাওয়া হবে, এখনও মানতে পারছি না।’’

এ দিকে এখনও পর্যন্ত রেল পুলিশের তদন্তও একটি জায়গায় গিয়ে আর বিশেষ এগোয়নি। রেলপুলিশের সাঁইথিয়া থানার ওসি বিকাশ মুখোপাধ্যায় এ দিনও জানান, বিশ্বভারতী ফাস্ট প্যাসেঞ্জার চলে যাওয়ার পরে বর্ধমান–রামপুরহাট লোকাল ট্রেন ফাঁকাই থাকে। ঘটনার দিনও একই রকম ছবি ছিল। প্রাথমিক তদন্তে অনুমান, রেল লাইনের উপরেই দেহ মেলায় সাধারণ ভাবে মনে করা হচ্ছে, জিষ্ণুকে কেউ ঠেলে ফেলে দেয়নি। ট্রেন থেকে কোনও ভাবে পা হড়কে পড়ে গিয়েই ছেলেটির মৃত্যু হয়েছে। কেউ ঠেলে ফেলে দিলে সাধারণত দেহটি রেল লাইন থেকে কিছুটা দূরে পড়ত বলেই বিকাশবাবুর দাবি। যদিও এ দিন পর্যন্ত ঘটনার কোনও প্রত্যক্ষদর্শীর হদিস বের করতে পারেনি রেল পুলিশ। ফলে সেই সিদ্ধান্তে চলে আসার আগে দু’বার ভাবতে হচ্ছে তদন্তকারীদের। তাই বিকাশবাবুও বলছেন, ‘‘ময়না-তদন্তের রিপোর্ট না পাওয়া গেলে কী ভাবে মৃত্যু হয়েছে, তা সঠিক ভাবে বলা যাবে না।’’

এ দিন আর সরস্বতী পুজো হয়নি শোকস্তব্ধ পাড়ায়। গ্রামের এমন মেধাবী ছাত্রের মৃত্যু রহস্যের কিনারা কবে হয়, আপাতত তারই অপেক্ষায় গোটা চাকপাড়া।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE