খাদানের ধুলোয় দূষণ ছড়াচ্ছে এলাকায়। পাঁচামিতে ছবিটি তুলেছেন অনির্বাণ সেন।
নাম শুনলেই রুখা-শুখা খাদানের যে ছবিটা সামনে চলে আসে। ষাটের দশকের আগেও পাঁচামির বললে ছবিটা তেমন ছিল না!
পাঁচামির ইতিহাস বেশ প্রাচীন। বহু আগে, জেলার পশ্চিমাঞ্চলের অধিকাংশ জায়গা ছিল সাঁওতাল পরগণার অন্তর্গত। আদিবাসী সমৃদ্ধ মহম্মদবাজারের পাঁচামি এলাকাও সাঁওতাল পরগণার অন্তর্ভুক্ত এবং নানকর রাজাদের অধীনে ছিল। ১৭৯৩ সালে সাঁওতাল জনজাতি পাহাড়ী অঞ্চল থেকে নেমে নানকর রাজাদের এই তালুতে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস শুরু করে। সে সময় এই এলাকার মানুষের মূল জীবন-জীবিকা ছিল কৃষি ও পশু পালন। জীবনযাত্রা ছিল অত্যন্ত সহজ সরল। শিকার ছিল, পশুপালন ছিল। দিন গড়াত সহজ জীবন-ছন্দে।
কিন্তু সে সুখ বেশি দিন সইল না। আদিবাসীদের সহজ সরল জীবন যাপনেও ব্রিটিশ শাসনের থাবা পড়ল। আদিবাসীরা গর্জে উঠলেন। ১৮৫০ সালে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে শুরু হল সাঁওতাল বিদ্রোহ। কেমন সে বিদ্রোহ?
একের পর এক এলাকা আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ল বিদ্রোহের আঁচ। একে একে বিদ্রোহে শামিল হল মহম্মদবাজারের হাবড়া পাহাড়ি, শিকারীপাড়া, হাটগাছা, তালবাঁধ, হরিণসিঙা, গাবারবাথান, ঢোলকাটা- সহ সমস্ত আদিবাসী গ্রামের মানুষ। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে শিঙা ফুঁকে সক্রিয় অংশ নেয় সব বয়সের মানুষ। হাবড়া পাহাড়ির বাসিন্দা নব্বই ছুঁই ছুঁই অবসর প্রাপ্ত শিক্ষক ভূষন টুডু ও তালবাঁধের সত্তরোর্ধ্ব বসন টুডুরা বলছিলেন, ‘‘সাঁওতাল পরগণার আগে এই এলাকা ছোটনাগপুর মালভূমির অধীন ছিল। কৃষি কাজের পাশাপাশি পশুপালনও ছিল এই এলাকার মানুষের প্রধান জীবিকা। তবে আদিবাসীদের মধ্যে শিক্ষার অভাব ছিল। ১৮৬৭ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর নানকর রাজা মেহের চন্দ্র রায়ের কাছ থেকে সাহেবরা এলাকায় মিশনারিজ শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য বেনেগড়িয়া অঞ্চলের(বর্তমানে যা শিকারীপাড়া নামে পরিচিত) ৫০ বিঘে জমি বন্দোবস্ত নেয় সাহেবরা। ক্রমশ বাড়তে থাকে এলাকা।
সেই সময়ই পি ও বোর্ডিং সাহেব এই এলাকায় মিশনারি শিক্ষা দানের পাশাপাশি আদিবাসী স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি, শিল্প ও আদিবাসীদের গাছ গাছালি ওষুধ পত্রের উপর যথেষ্ট আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। তাঁর লেখা ‘দ্যা অরিজিন অফ ট্রাইবাল’ ও ‘হারবাল মেডিসিন অফ ট্রাইবাল’ বই দুটিতে উল্লেখ রয়েছে সেই সময়ের কথা। ভূমিপুত্র, সিউড়ি বেনীমাধব স্কুলের শিক্ষক তথা গাঁওতা নেতা সুনীল সোরেন বলেন, ‘‘আদিবাসী সম্প্রদায়ের গাছ গাছালি থেকে তৈরি ওষুধ তিনি বৃটেনে নিয়ে গিয়ে ব্যবহার করেছিলেন। এবং প্রচুর সম্মানিত হয়েছিলেন বলেও তাঁর বই দুটিতে উল্লেখ রয়েছে।’’
ইতিহাসের সেই পাঁচামি এখন জেলার অন্যতম শিল্পাঞ্চল নামে খ্যাত। জেলা ছাড়িয়ে রাজ্য ও দেশের শিল্প মহল তাকে জানে মহম্মদবাজারের পাঁচামি পাথর শিল্পাঞ্চল বলে। এই শিল্পাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে এখনও আদিবাসীদের বাস। পাথর শিল্পাঞ্চলের আগে এই এলাকার মূল জীবিকা ছিল কৃষি ও পশুপালন। তবে, পাথর শিল্পের আগে ১৭৭৯ সালে পাঁচামি এলাকা সংলগ্ন দেউচাতে ‘মেসার্স মট এন্ড ফার্কুহার’ বৃটিশ কোম্পানি প্রথম কামান ও গোলাগুলি তৈরির শিল্প গড়ে তোলে। কৃষি কাজে যুক্ত বহু আদিবাসী শ্রমিক কৃষি কাজ ছেড়ে যোগ দেন বৃটিশদের ওই কারখানায়। কয়েক দশক চলার পর সে কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। থেমে যায় এলাকার শিল্প সংস্থা। বেকার হয়ে পড়েন ওই শিল্পে যুক্ত শ্রমিকেরা। তাঁরা ফের ফিরে যায় কৃষি কাজে।
সে সময় ওই রুক্ষ এলাকায় কৃষি বলতে মূলত ভূট্টা, বাজরা, তিল, সরিষা, অড়হর, কুরতি কলাই ও খেরো (এক ধরনের ফসল) প্রচুর পরিমানে উৎপন্ন হত। ধান-গমও হত, তবে তা চাহিদার তুলনায় কম। আর প্রচুর পরিমানে চারণভূমি থাকায় পশু পালনও ছিল এলাকার মানুষের অন্যতম পেশা। তবে সে সব এখন প্রায় গল্প কথা। পাথর শিল্পের কারণে চাষ জমির পাশাপাশি চারণভূমিও কমে গেছে।
ভাবলেও অবাক হতে হয়, একটি এলাকা এমন পেশা বদল করতে করতে এগিয়ে চলেছে। একসময় কৃষি ও পশুপালনের পাশাপাশি এখানকার আরও একটি পেশা ছিল শালপাতা তৈরি ও জ্বালানি কাঠ বিক্রি। সাগরবাঁধি গ্রামের প্রবীণা গাঁওতা নেত্রী বুধনি টুডু বলেন, ‘‘পাথর শিল্প হওয়ার আগে এই এলাকায় শাল, মহুয়া, পিয়াল-সহ নানা গাছ গাছালিতে ভরা ছিল। আমরা ছোট বেলায় মা-মাসিদের সঙ্গে বনে জঙ্গলে শালপাতা ও জ্বালানি কাঠ কুড়াতাম। একটা একটা করে পাতা গেঁথে মল্লারপুর, মহম্মদবাজার, সাঁইথিয়া হাটে পাতা ও জ্বালানি কাঠ বিক্রি করতে যেতাম। তখন কোনও খুনো-খুনি হানাহানির ভয় ছিল না। এখন কার মতো মানুষে ভয়ও ছিল না। ভয় ছিল শুধু হিংস্র জীব জন্তুর।’’
গাঁওতা নেত্রী বুধনি তাঁর বক্তব্যে যে ইঙ্গিত ছুড়ে দিলেন, তার মধ্যেই রয়েছে মহম্মহদবাজারে বদলে যাওয়ার ধরতাই। গাঁওতা সম্পাদক রবিন সোরেন বলেন, ‘‘এলাকায় পাথর শিল্প গড়ে ওঠার পর জীবন-জীবিকার মান পাল্টেছে ঠিকই। কিন্তু মানুষের দুর্দশা কমেনি, বরং বেড়ে গিয়েছে। এখানে বিষিয়ে উঠেছে বাতাস। নিয়ম মেনে দূষন মুক্ত শিল্প হোক।’’
মহম্মদবাজারের বিডিও সুমন বিশ্বাস বলেন, ‘‘এখানকার আদিবাসীদের ইতিহাস বহু প্রাচীন। এলাকায় দূষন সংক্রান্ত সমস্যা আছে। তবে তা আগের চেয়ে অনেক কমে গিয়েছে। সরকার যে রকম পদক্ষেপ নিচ্ছে, তাতে আশাকরি আগামী দিনে দূষণ আরও কমে যাবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy