Advertisement
১৭ এপ্রিল ২০২৪

পরিচারিকা নয়, বিয়েই করে সনাতন

শিশু সুরক্ষা কমিশনের চিঠি পেয়ে অতিরিক্ত জেলাশাসকের নেতৃত্বে জেলা প্রশাসনের ছ’জনের একটি দল এ দিন নদিয়াড়া গ্রামে সামাজিক-তদন্তে যান। সঙ্গে ছিলেন সিধো কানহো বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্বের শিক্ষক সৌম্যজিৎ পাত্র ও মনস্তত্ব বিভাগের শিক্ষক সমীররঞ্জন অধিকারী।

সাক্ষাৎ: সনাতনের মায়ের সঙ্গে অতিরিক্ত জেলাশাসক। নিজস্ব চিত্র

সাক্ষাৎ: সনাতনের মায়ের সঙ্গে অতিরিক্ত জেলাশাসক। নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
পুরুলিয়া শেষ আপডেট: ২৭ জুলাই ২০১৭ ০১:৫২
Share: Save:

নির্যাতিতা শিশুর মাকে তাঁর বাড়িতে অনুষ্ঠান করে বিয়ে করেছিল সনাতন গোস্বামী (ঠাকুর)। বুধবার সনাতনের গ্রাম পুরুলিয়া মফস্‌সল থানার নদিয়াড়া গ্রামে সামাজিক তদন্তে গিয়ে এমনই তথ্য পেলেন জেলা প্রশাসনের কর্তারা। জেল হাজতে থাকা শিশুটির মা-ও প্রশাসনের কর্তাদের কাছে তা স্বীকার করেছেন। অতিরিক্ত জেলাশাসক (সাধারণ) উত্তমকুমার অধিকারী বলেন, ‘‘এ দিন গ্রামে গিয়ে লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে এ বছরের দোলের সময় ওই মহিলাকে সনাতন বিয়ে করে। জেলা সংশোধনাগারে ওই মহিলাও আমাদের কাছে তা স্বীকার করেছেন।’’ তিনি জানান, সনাতনের বাড়িতে দু’জনের এক সঙ্গে স্টুডিওতে তোলা একটি ছবিও পাওয়া গিয়েছে।

চাইল্ডলাইন ও পুলিশের কাছে বছর তিরিশের ওই মহিলা প্রথম দিকে দাবি করেছিলেন, বছর বাষট্টির সনাতনের বাড়িতে তিনি মেয়েকে নিয়ে থেকে মাসখানেক ধরে পরিচারিকার কাজ করছিলেন। সনাতনই তাঁর সাড়ে তিন বছরের মেয়ের উপরে অত্যাচার করেছে বলে চাইল্ডলাইনের কর্মীদের কাছে তিনি অভিযোগও করেন। পরে কলকাতার এসএসকেএম-এ শিশুটির শরীরে বিঁধে থাকা সাতটি সুচ বার করা হয়। কিন্তু শিশুটিকে বাঁচানো যায়নি। শুক্রবার ভোরে তার মৃত্যু হয়। শিশুটির মায়ের জড়িত থাকার সন্দেহে পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। তিনি বর্তমানে পুরুলিয়া জেলা সংশোধনাগারে রয়েছেন।

শিশু সুরক্ষা কমিশনের চিঠি পেয়ে অতিরিক্ত জেলাশাসকের নেতৃত্বে জেলা প্রশাসনের ছ’জনের একটি দল এ দিন নদিয়াড়া গ্রামে সামাজিক-তদন্তে যান। সঙ্গে ছিলেন সিধো কানহো বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্বের শিক্ষক সৌম্যজিৎ পাত্র ও মনস্তত্ব বিভাগের শিক্ষক সমীররঞ্জন অধিকারী। ওই দল সূত্রে জানা গিয়েছে, এ দিন সনাতনের ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু তাঁদের জানিয়েছেন, দোলের দিন ওই থানারই সাতেরো গ্রামে মহিলার মায়ের বাড়িতে ধর্মীয় অনুষ্ঠান করে তাঁদের বিয়ে হয়েছিল। সনাতনের দুই পুত্রবধূ রীনা ও রিঙ্কিও তাঁদের জানিয়েছেন, গত বছর জুলাই মাসে শ্বাশুড়ি প্রভাবতীদেবীর শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের পরেই সনাতন জানিয়েছিল সে আবার বিয়ে করছে। অতিরিক্ত জেলাশাসক বলেন, ‘‘গ্রামবাসী ও সনাতনের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে সনাতনের ঘরের দেওয়ালে দু’জনের ছবি দেখার পরে বোঝা যাচ্ছে, ওই মহিলাকে বিয়ে করেছিলেন সনাতন।”

পুলিশের উপস্থিতিতে এতদিন বন্ধ থাকা সনাতনের ঘরটি খোলেন দলের সদস্যেরা। জানা গিয়েছে, খাটের একপাশে সনাতন ও মঙ্গলার এক সঙ্গে তোলা বাঁধানো ছবি রয়েছে। বাক্সের উপরে পড়েছিল ছোট লালরঙের একটি পুতুল। ছুরি, কাঁচি-সহ কিছু ছোট ধারাল অস্ত্র দেখেছেন দলের সদস্যেরা। এ ছাড়াও তন্ত্র সাধনার কিছু বই পাওয়া গিয়েছে। সব দেখে অতিরিক্ত জেলাশাসকের মন্তব্য, ‘‘সনাতন যে ঝাঁড়ফুক ও ওঝার কাজ করত তা স্পষ্ট।’’

অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার বা অন্য কী কারণ এই মর্মান্তিক ঘটনার পিছনে রয়েছে, সামাজিক তদন্তের মাধ্যমে এই বিষয়গুলিই জানার জন্য ওই দলের নদিয়াড়ায় যাওয়া। ওই মা তাঁর সন্তানের উপরে অত্যাচার হচ্ছে দেখেও চুপ করে ছিলেন কি না, তাও ভাবাচ্ছে ওই দলের সদস্যদের।

সনাতনকে দেখলেই ওই শিশুটি যে কুঁকড়ে যেত, সেটাও এ দিন গ্রামবাসীদের কাছ থেকে জেনেছেন ওই কর্তারা। তাঁদের কাছ থেকে জানা গিয়েছে, বিয়ের পরে নদিয়াড়ায় সনাতনের সঙ্গে ঘর সংসার করতে গেলে ওই মহিলা তার একরত্তি মেয়েকে সেখানে সঙ্গে করে আনেননি। সে থাকত দিদিমার কাছেই। মাঝে মধ্যে কয়েকদিন জন্য মেয়ের কাছে নাতনিকে রেখে যেতেন ওই বৃদ্ধা। পড়শিরা জানান, কয়েকদিন পরে দিদিমা তাকে নিতে এলে শিশুটি তাঁর কাছে যাওয়ার জন্য ছটফট করত।

অবশ্য জুন মাসের শেষ দিকে নদিয়াড়ায় শিশুটিকে পাকাপাকি ভাবে রেখে যান ওই বৃদ্ধা। এ সব শুনেই দলের সদস্যদের পর্যবেক্ষণ, দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর সন্তানকে ভাল ভাবে গ্রহণ করেনি সনাতন। শিশুটির উপরে যে নিয়মিত অত্যাচার চালাত সে বিষয়টি মোটামুটি স্পষ্ট।

তবে এ দিনই তদন্ত শেষ হয়নি বলে জানাচ্ছেন জেলাশাসক অলোকেশপ্রসাদ রায়। তিনি বলেন, ‘‘তদন্ত শুরু হয়েছে। আরও কয়েকদিন চলবে। এ দিন কী ধরনের তথ্য উঠে এসেছে, তা খতিয়ে দেখে রাজ্য শিশু সুরক্ষা দফতরের কাছে রিপোর্ট পাঠানো হবে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE