Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

ডাইনি অপবাদে ধুন্ধুমার, বাঁচাতেই হবে মৃত শিশুকে

ফের ডাইনি অপবাদে হেনস্থার শিকার দুই প্রৌঢ়া। তাঁদের নজর লেগেই গ্রামের এক শিশুকন্যার মৃত্যু হয়েছে, এই অপবাদ দিয়ে মাটি খুঁড়ে আড়াই বছরের মৃত শিশুর দেহ তুলে দুই প্রৌঢ়ার কাছে সেই শিশুকে বাঁচিয়ে তোলার দাবি তুললেন গ্রামবাসীরা।

তর্ক: পুলিশকর্তা বোঝানোর চেষ্টা করছেন গোঁসাইডাঙার বাসিন্দাদের। এর পরেও তেতে ওঠে পরিস্থিতি। মঙ্গলবার। —নিজস্ব চিত্র।

তর্ক: পুলিশকর্তা বোঝানোর চেষ্টা করছেন গোঁসাইডাঙার বাসিন্দাদের। এর পরেও তেতে ওঠে পরিস্থিতি। মঙ্গলবার। —নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
আদ্রা শেষ আপডেট: ২৪ মে ২০১৭ ১২:৫৩
Share: Save:

কুসংস্কারের শিকড় কতটা গভীরে গাঁথা, ফের দেখল পুরুলিয়া।

ফের ডাইনি অপবাদে হেনস্থার শিকার দুই প্রৌঢ়া। তাঁদের নজর লেগেই গ্রামের এক শিশুকন্যার মৃত্যু হয়েছে, এই অপবাদ দিয়ে মাটি খুঁড়ে আড়াই বছরের মৃত শিশুর দেহ তুলে দুই প্রৌঢ়ার কাছে সেই শিশুকে বাঁচিয়ে তোলার দাবি তুললেন গ্রামবাসীরা। ওই দুই মহিলা মৃত শিশুর ঠাকুমা ও পিসি ঠাকুমা। ঘটনা ঘিরে মঙ্গলবার ধুন্ধুমার বাধে আদ্রা থানার গোঁসাইডাঙা গ্রামে।

দিনভর মৃত শিশুর সঙ্গে ওই দুই প্রৌঢ়াকেও ঘিরে রাখেন গ্রামবাসীর একাংশ। খবর পেয়ে আদ্রা থানা থেকে পুলিশ গেলে গ্রামবাসীরা তাদের ঢুকতে দেননি। পৌঁছন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পারিজাত বিশ্বাস। বুঝিয়েও কাজ হচ্ছে না দেখে কার্যত জোর করেই পুলিশ শিশুটির দেহ ও দুই প্রৌঢ়াকে নিজেদের গাড়িতে তোলে। এতেই খেপে গিয়ে গ্রামবাসীরা পুলিশকর্মীদের লক্ষ করে ইট-পাটকেল ছুড়তে থাকেন। ভাঙচুর করা হয় পুলিশের গাড়ি। ঢিলের ঘায়ে আদ্রা থানার ওসি মুকুল কর্মকার-সহ তিন জন চোট পান। পরিস্থিতি আয়ত্তে আনতে পুলিশ লাঠি চালায়।

জেলা পুলিশ সুপার জয় বিশ্বাস বলেন, ‘‘পুলিশের গাড়ি গ্রাম থেকে বেরনোর সময় আক্রমণ করা হয়। ওই ঘটনায় এখনও পর্যন্ত সাত জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।’’ ধৃতদের মধ্যে মৃত শিশুর মা রয়েছেন। তবে লাঠি চালানোর অভিযোগ মানতে চাননি পুলিশ সুপার।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, গত শনিবার গোঁসাইডাঙা গ্রামের দম্পতি অরুণ মাল ও মালা মালের আড়াই বছরের মেয়ে রিয়ার মৃত্যু হয় জ্বরে ভুগে। রবিবার তার দেহ গ্রামের বাইরে মাটি খুঁড়ে সমাধিস্থ করা হয়। এর আগেও ওই দম্পতির দুই সন্তান মারা গিয়েছে। সোমবার গ্রামে কোনও ভাবে রটানো হয়, মালার শাশুড়ি এবং পিসি শাশুড়ি ডাইনি। তাঁদের নজর লেগেই বাচ্চাটি মারা গিয়েছে। অরুণ, মালা-সহ গ্রামের কিছু লোক ওই দুই মহিলাকে চেপে ধরেন। ডাইনি অপবাদ দিয়ে তাঁদের মারধর করা হয় বলেও অভিযোগ।

অন্ধবিশ্বাসের এখানেই শেষ নয়। ঠাকুমা ও পিসি-ঠাকুমাকেই বলা হয় রিয়াকে বাঁচিয়ে তুলতে। মঙ্গলবার সকাল হতেই গ্রামে আশপাশের কমলডাঙা, আড়রা, বড়বাগান-সহ বিভিন্ন গ্রামের লোকজন গোঁসাইডাঙায় ভিড় করেন। ওই দুই প্রৌঢ়াকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে মাটি খুঁড়ে রিয়ার দেহ তোলা হয়। অন্ধবিশ্বাস এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, উপস্থিত অনেকের হাতেই তখন মোবাইল ক্যামেরা। শিশুকন্যার বেঁচে ওঠার দৃশ্য তাঁরা মোবাইলে ধরে রাখবেন!

মৃতদেহ সমেত ওই দুই প্রৌঢ়াকে গ্রামে ফিরিয়ে এনে শিশুটিকে বাঁচিয়ে তোলার জন্য চাপ দিতে থাকে জনতা। অসহায় দুই মহিলা কাঁদতে শুরু করেন। বারবার বলেন, মৃত কাউকে বাঁচানো সম্ভব নয়। কিন্তু, কেউ সে কথায় কান দেননি। ক্রমশ উত্তেজনার পারদ চড়তে থাকে গ্রামে। খবর পেয়ে পুলিশ গ্রামে ঢুকতেই গোলমাল বাধে। শেষ অবধি পুলিশ অবশ্য তাঁদের উদ্ধার করতে সমর্থ হয়।

ওই দুই প্রৌঢ়া এ দিন বলেন, ‘‘আমাদের ডাইনি বলে মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে বৌমা ও পড়শিরা। নিজের নাতনিকে কি কেউ মারতে পারে? কাল রাত্রে বৌমা পাড়ার কয়েকজনকে নিয়ে এসে বলে যে আমরাই ডাইনি। মেয়েকে এখন বাঁচিয়ে দিতে হবে।’’ তাঁদের আরও অভিযোগ, রিয়াকে না বাঁচাতে পারলে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকিও দেওয়া হয়। এ দিন ভোরে এক দফা মারধর করা হয় তাঁদের। ভয়ে তাঁরা সবার সামনে বলে ফেলেন, রিয়াকে বাঁচিয়ে দেবেন। বিপত্তি তাতে আরও বাড়ে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Witch Harassment villagers
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE