Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

অঙ্ক কষছে সব পক্ষই, শুধু ফর্মুলাটা আলাদা

ঠিক যেন পরীক্ষার খাতায় সরল অঙ্ক। এক এক জনের উত্তর এক এক রকম! পুরুলিয়া কেন্দ্রের চার প্রার্থীর কার অঙ্কের উত্তর মিলল, সেটা ১৬ মে-র আগে জানার উপায় নেই। কংগ্রেস প্রার্থী, অঙ্কের মাস্টারমশাই নেপাল মাহাতো অবশ্য বলছেন, “সঠিক ফর্মুলা প্রয়োগ করলে উত্তর মিলে যাবেই।” ৪২-৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার তোয়াক্কা না-করে চরকির মতো ঘুরতে থাকা নেপালবাবুর ফর্মুলাটা কী?

গার্গী গুহঠাকুরতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:২১
Share: Save:

ঠিক যেন পরীক্ষার খাতায় সরল অঙ্ক। এক এক জনের উত্তর এক এক রকম!

পুরুলিয়া কেন্দ্রের চার প্রার্থীর কার অঙ্কের উত্তর মিলল, সেটা ১৬ মে-র আগে জানার উপায় নেই।

কংগ্রেস প্রার্থী, অঙ্কের মাস্টারমশাই নেপাল মাহাতো অবশ্য বলছেন, “সঠিক ফর্মুলা প্রয়োগ করলে উত্তর মিলে যাবেই।” ৪২-৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার তোয়াক্কা না-করে চরকির মতো ঘুরতে থাকা নেপালবাবুর ফর্মুলাটা কী? অন্তত হাজার বুথে একশো থেকে দেড়শো ভোট নিজের দিকে ঘোরানো। ভোটের পরিভাষায় যাকে বলে ‘ভোট সুইং’। সকালে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। তার পর মিছিল করে ঘুরেছেন পুরুলিয়া শহরে। সন্ধ্যায় সাহেববাঁধের কাছে ভিড়েঠাসা দলীয় কার্যালয়ে বসে দেড় লক্ষ বাড়তি ভোট টানার হিসেব শোনাচ্ছিলেন সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি আর স্নিকার্স পরিহিত অঙ্কের মাস্টারমশায়।

ইটে লাল পাঞ্জাবি, সাদা পাজামা ও চটি পরা হেড মাস্টারমশাই নরহরি মাহাতোও ভোট কাটার অঙ্ক কষছেন। বেশ কয়েক বার মোবাইল ফোনে ধরে অবশেষে সময় পাওয়া গেল ফরওয়ার্ড ব্লক প্রার্থী তথা বর্তমান সাংসদের। তার পরেও পুরুলিয়ার জেলা স্কুল মোড়ের কাছে পার্টি অফিসে অপেক্ষা করতে হল প্রায় এক ঘণ্টা। কারণ, নরহরিবাবু গিয়েছেন অযোধ্যা পাহাড়ে। যেখানকার গ্রামগুলিতে বছরখানেক আগেও মাওবাদীদের দাপটে ভোটপ্রচার করার জো ছিল না।

শান্তি ফেরানোর জন্য নম্বর দেবেন না শাসক দলকে? প্রশ্ন এড়িয়ে চটজলদি অঙ্কে ঢুকে পড়লেন নরহরিবাবু। কড়া মিষ্টি দেওয়া চায়ে চুমুক দিতে দিতে বললেন, “পঞ্চায়েত ভোটে তৃণমূলের সঙ্গে আমাদের ভোটের ফারাক মাত্র ৪ শতাংশ। কংগ্রেস এবং বিজেপি তৃণমূলের ভোট কাটবে। আমাদের নয়।” পাশাপাশি তাঁর ভরসা তৃণমূলের অন্তর্দ্বন্দ্ব। সঙ্গে থাকছে ৮৩ হাজার নতুন ভোটার ঘিরে আশার অঙ্ক।

দলের অন্দরমহলে কোন্দলের কথা উড়িয়ে অন্য ফর্মুলায় অঙ্ক কষছেন তৃণমূলের প্রার্থী, চক্ষু বিশেষজ্ঞ মৃগাঙ্ক মাহাতো। তাঁর পাল্টা পরিসংখ্যান: গত পঞ্চায়েত ভোটে প্রায় ৪২ শতাংশ ভোট পেয়েছে তৃণমূল। কংগ্রেস পেয়েছে মাত্র ১৭ শতাংশ। অতএব ভোট কাটাকাটির যা হিসেব, তা আগেই কষা হয়ে গিয়েছে। তা নিয়ে নতুন করে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই, দাবি পুরুলিয়া রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যাপীঠ এবং কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের প্রাক্তন ছাত্রের।

কিন্তু গোষ্ঠী কোন্দলের অঙ্কটা কি এত সহজে কষে ফেলা যাবে? সেই অঙ্ক জটিল করে দেওয়ার মতো সমস্যা যে আছে, তা তো খালি চোখেই দেখা যাচ্ছে। বলরামপুর থেকে পুরুলিয়া শহরে আসার রাস্তায় প্রায় পাশাপাশি তৃণমূলের দু’টি পার্টি অফিস। মাঝে শুধু একটি বাড়ি। একটি অফিসে বসেন ফরওয়ার্ড ব্লক থেকে আসা নতুন সদস্যরা। অন্যটিতে সাবেক তৃণমূল কর্মীরা! জানাচ্ছেন এলাকার বাসিন্দারা। আর মৃগাঙ্কবাবুর পাশে বসা এক স্থানীয় তৃণমূল নেতা জানাচ্ছেন, জেলায় ফরওয়ার্ড ব্লকের প্রায় ৫০ শতাংশ কর্মী এখন নাম লিখিয়েছেন তৃণমূলে। কংগ্রেস ছেড়েও এসেছেন অনেকে। সুতরাং রাজ্যের আর পাঁচটা জায়গার মতো পুরুলিয়া তৃণমূলেও যে নতুন-পুরনোর দ্বন্দ্ব বহাল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

রাজনীতির আবহে বড় হলেও এত দিন প্রত্যক্ষ ভাবে রাজনীতিতে জড়িত না-থাকা মৃগাঙ্কবাবুর অবশ্য দাবি, দল বড় করতে নতুন সদস্য প্রয়োজন। এটাই স্বাভাবিক। তাই বলে নতুন-পুরনোর মধ্যে কোনও বিভেদ নেই। যে ভাল কাজ করবে, সেই গুরুত্ব পাবে।

তৃণমূলের বিরোধীরা, তা সে বামই হোক বা ডান, কিন্তু এই বিভাজন নিয়েই সরব। নেপালবাবুর মন্তব্য, “পঞ্চায়েত নির্বাচন জিতে ওঁদের কাল হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই নতুন সদস্যরা ক্ষমতা পেয়েছেন। সেই সূত্রে পঞ্চায়েতের তহবিলও তাঁদের হাতে। ফলে পুরনোরা নিজেদের বঞ্চিত মনে করছেন ও দলবিরোধী কাজ করছেন।” একই সুরে নরহরিবাবু জানান, যাঁরা ফরওয়ার্ড ব্লক ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন, তাঁরা কিছু সুবিধা পাওয়ার আশায় গিয়েছেন। নীতির ভিত্তিতে না-গেলে সমস্যা হবেই।

এমনিতে পুরুলিয়ার লড়াই দ্বিমুখী হওয়ার কথা। কংগ্রেসের তিন বারের বিধায়ক নেপাল মাহাতো মাঠে নামায় তা ত্রিমুখী হয়েছে। আর দেশ জোড়া মোদী হাওয়ায় খানিকটা হলেও লড়াইয়ে জুড়ে গিয়েছেন বিজেপি প্রার্থী বিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু বাকি তিন প্রার্থীর মিটিং-মিছিল, দেওয়াল লিখন ও প্রচারের জাঁকজমকের পাশে তিনি বেশ কিছুটা ম্লান। সে কথা মেনে নিয়েই বিকাশবাবু বলছেন, “শহরে আমার দেওয়াল লিখন কম হয়েছে। তবে গ্রামেগঞ্জে যথেষ্টই চোখে পড়ছে আমাদের দলের প্রচার।”

পেশায় কৃষক বিকাশবাবুর ফর্মুলা আবার অন্য। তাঁর দাবি, পুরুলিয়া লোকসভা কেন্দ্রে দু’লক্ষের বেশি প্রার্থীর বয়স ২৫ থেকে ২৬ বছরের মধ্যে। এই তরুণ প্রজন্ম মোদীকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চায়। তাই তাদের ভোটও আসবে তাঁরই বাক্সে। সেই সঙ্গে আমজনতার পাশেও যে তাঁরা আছেন, সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে বিজেপি প্রার্থী বলছেন, “ইতিমধ্যেই লক্ষাধিক ভোটারের সঙ্গে দেখা করেছি। তাঁদের বলেছি, অটলবিহারী বাজপেয়ীর আমলে কেজি প্রতি তিন টাকা দরে চাল ও গম দেওয়া হয়েছে। পরিবার-পিছু ৩৫ কেজি চাল বা গম দিয়েছিল আমাদের সরকার।”

ডোল দেওয়ার কথাই অবশ্য বলতে হবে রুখুশুখু পুরুলিয়ায়। গোটা জেলায় শিল্প বলতে গেলে নেই। সুতরাং নেই শিল্পমহলও। পুরুলিয়া শহরের ১০০ বছরের পুরনো ইউনিয়ন ক্লাবে সান্ধ্য আড্ডা দিচ্ছিলেন তিন প্রৌঢ়। তৃণমূল বিধায়ক কে পি সিংহ দেও-র আত্মীয় জে পি সিংহ দেও জানালেন, এক সময়ে এই ক্লাবে বিলিয়ার্ডস, লন টেনিসের মতো সাহেবি খেলাধুলো হতো। এখন খেলোয়াড়ের অভাবে তা বন্ধ। কর্পোরেট মহল নেই। ফলে সদস্য সংখ্যাও কমতির দিকে।

অতএব আমজনতাকে নিয়েই চার দলের যাবতীয় অঙ্ক পুরুলিয়ায়। যাঁদের নিয়ে অঙ্ক, পাল্টা অঙ্ক কষছেন তাঁরাও। যেমন পুরুলিয়া শহরের বাসিন্দা সুরজিৎ দাস। এখন বাড়িতে কেউ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে, গাড়ি ভাড়া করে ছুটতে হয় রাঁচি, বোকারো বা বাঁকুড়ায়। পুরুলিয়া সদর হাসপাতালে ২২০ জন ডাক্তার থাকার কথা। রয়েছেন মাত্র ৮০ জন! সুরজিৎবাবুর আশা, চিকিৎসক প্রার্থী জিতলে ডাক্তারের সংখ্যা বাড়তে পারে। বাঁচতে পারে জেলার বাইরে যাওয়ার হ্যাপা ও বাড়তি খরচ।

কাগজ-পেন্সিলে অঙ্ক কষতে পারেন না ভুদা গ্রামের রামু মুড়া, সুমিত্রা মুড়া, পবন মুড়া। তবু অঙ্ক কষছেন তাঁরাও। ১৫০ ঘরের গ্রামে মাত্র একটি নলকূপ। ভোট জিতে নলকূপের সংখ্যা বাড়াবেন কেউ? তা যদি নাও হয়, ভোটের বদলে একটি কালভার্ট কি পাওয়া যাবে? অযোধ্যা পাহাড়ের এই গ্রামের পাশেই বাঁদু নদী। সেই নদী বর্ষায় পাড় ভেঙে নিয়ে যায়। নদী পেরিয়ে হাট বা হাসপাতাল, কোথাও যাওয়া যায় না।

একই অঙ্ক কষেন শিমূলবেড়ের চুনি টুডু, রতনি মুর্মু, সুখমনি টুডু। আগে ১৬ কিলোমিটার পাহাড়ের রাস্তা ভেঙে ভোট দিতে যেতেন তাঁরা। এখন গ্রামেই বুথ হয়েছে। এই প্রাপ্তিতে খুশি ওঁরা। সঙ্গে আশা আর একটা নলকূপও যদি পাওয়া যায়। নিত্যদিন কুঁড়াল শাকের সুজি আর ভুট্টার মাড় খেয়ে ওঁদের অঙ্কে ঘুরেফিরে আসে নলকূপ আর নদীর উপর বাঁধ তৈরির অঙ্ক। ছাতনি, চুরিনসড়, পুনিয়াশাসন, ঘাটবেড়ে, সাহেবডিহি এক সময়ের মাওবাদীদের ডেরা এ সব গ্রামের গল্প একই। অঙ্কও এক।

সবাই অঙ্ক কষছে।

ফর্মুলাটা আলাদা!

সবিস্তার দেখতে ক্লিক করুন...

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

gargi ghuhothakuta purulia
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE