Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

কুমারী নদীর ঘাটে ভাদুর মেলায় মানুষের ঢল

যেও না যেও ভাদু, দাঁড়াও নদী কূলে/ বছর পরে আবার এসো, যেও নাকো ভুলে/ পান দেব সুপারি দেব, ওই রাঙ্গা ঠোঁটে গো/ খিলখিলিয়ে হাসির ছটা, নদীর ওই জলে গো।’ বৃহস্পতিবার বাসিন্দাদের এমনই গানে মুখরিত থাকল দুয়ারশিনির নদীঘাট। ফি বছর ভাদু ভাসানকে কেন্দ্র করে মেলা বসে দুয়ারশিনি ঘাটে। মানবাজার, বরাবাজার ও বোরো থানা এলাকার বহু মানুষ কুমারী নদীর দুয়ারশিনি ঘাটে ভাদু বিসর্জন উপলক্ষ্যে আসেন।

নিজস্ব সংবাদদাতা
মানবাজার শেষ আপডেট: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০২:০২
Share: Save:

যেও না যেও ভাদু, দাঁড়াও নদী কূলে
বছর পরে আবার এসো, যেও নাকো ভুলে
পান দেব সুপারি দেব, ওই রাঙ্গা ঠোঁটে গো
খিলখিলিয়ে হাসির ছটা, নদীর ওই জলে গো।’

বৃহস্পতিবার বাসিন্দাদের এমনই গানে মুখরিত থাকল দুয়ারশিনির নদীঘাট। ফি বছর ভাদু ভাসানকে কেন্দ্র করে মেলা বসে দুয়ারশিনি ঘাটে। মানবাজার, বরাবাজার ও বোরো থানা এলাকার বহু মানুষ কুমারী নদীর দুয়ারশিনি ঘাটে ভাদু বিসর্জন উপলক্ষ্যে আসেন। এ বারও এসেছিলেন অনেকে। আট থেকে আশির উচ্ছ্বাস দেখা দিল।

কবে থেকে ভাদু ভাসানের এই মেলা শুরু হয়েছিল, এ ইতিহাস অনেকের অজানা। লোক সংস্কৃতির এই ধারাকে জঙ্গলমহলের বাসিন্দারাই ধরে রেখেছেন। গবেষকদের মতে, মানুষের জীবন যতই ভোগবাদের পিছনে ছুটুক, এই প্রত্যন্ত এলাকার বাসিন্দারাই লোক-সংস্কৃতির ধারাকে বহণ করে চলেছে। অনেকের কাছে এই উৎসবগুলোই বিনোদন। বছরভর তাঁরা এই উৎসবের জন্য অপেক্ষা করে থাকেন।

মেলাতেও পরিবর্তন এসেছে। দুয়ারশিনি গ্রামের বাসিন্দা সুনীল মাহাতো বলেন, “মেলায় মহিলাদের সংখ্যাই বেশি। আগে ৮-১০ কিমি দূর থেকে হেঁটে অনেকে মেলায় আসতেন। এখন ছোট গাড়িতে চড়ে আসেন।” রাস্তার দু’পাশে খাটিয়ায় দোকান বসেছে। লাল টুকটুকে জিলিপি, বোঁদের লাড্ডু, পাঁপড়ভাজা বিক্রি হচ্ছিল। বিকেল ৩টের সময় মানবাজার থানার বামনি গ্রামের একদল কিশোরী ও কয়েকজন মধ্যবয়স্কা গান গাইতে গাইতে ঘাটে এলেন। হাতে তাঁদের মাইক্রোফোন। সাইকেলের হ্যান্ডেলে মাইকের চোঙা বাঁধা। পিছনে ক্যারিয়ারে বাঁধা ছোট সাউন্ডবক্স। থামলে একেবারে নদীঘাটে। কিশোরী নমিতা মাহাতো বলেন, “সাড়ে চারশো টাকা ভাড়া করে মাউক-বক্স এনেছি। এই উৎসবের দিকে বছরভর আমরা তাকিয়ে থাকি।” মধ্যবয়স্কা প্রমীলাদেবী শাড়ির খুঁটে বাঁধা টাকাগুলো গুনে মাইকের লোককে দিলেন। বরাবাজারের চৌকান গ্রামের একটি দল ইতিমধ্যে ঘাটে এসে পড়েছিল। তাঁরা প্রতিমার গায়ে জড়ানো ওড়না, গয়না একে একে খুলে ফেললেন। তাঁদের মধ্যে সবিতা মাহাতো বলেন, “ভাদুর গা থেকে এ গুলো খুলে দিতে মন চায় না। কিন্তু জিনিসের যা দাম বেড়েছে, এ গুলো যত্ন করে রেখে দেব। আগামী বছর আবার ব্যবহার করা যাবে।”

গবেষকদের কথায় পুরুলিয়া তথা বৃহত্তর মানভূম এলাকায় কৃষিভিত্তিক এইসব লোক উৎসবগুলি প্রান্তিক বাসিন্দারাই টিকিয়ে রেখেছেন। টুসু, ভাদু, করম পুজো উপলক্ষ্যে একেবারে নিরক্ষর বাসিন্দারাও মুখে মুখে গান রচনা করেন। লোকে দেব-দেবীকে বাড়ির মেয়ে, মা, কখনও সখি হিসাবে কল্পনা করে লোকগান রচনা করেন।

তবে এ দিন নদীঘাটে ভাদুর সংখ্যা কম দেখে হা-হুতাশ করছিলেন কয়েকজন প্রবীণ। তাঁরা স্মৃতি হাতড়ে বলেন, “সবই কেমন পাল্টে যাচ্ছে। বছর কুড়ি আগেও এই ঘাটে কয়েকশো ভাদু প্রতিমা বিসর্জন হত। গানের লড়াই হত। গানে-গানে প্রশ্ন এবং গানেই-গানেই তার জবাব মিলত। ‘আমার ভাদু দেখতে সুন্দরি, তোদের ভাদুর চোখ ট্যারা’ এ ধরনের ব্যঙ্গাত্মক ছড়া কাটা হত। সে দৃশ্য ভোলবার নয়।” ঝাপসা হয়ে যায়, প্রবীণ চোখ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

kumari river bank bhadu mela manbazar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE