ময়ূরেশ্বরের নবগ্রামে এ ভাবেই দিন কাটে বৃদ্ধার। ছবি: সোমনাথ মুস্তাফি
‘ডাইন’ অপবাদ দিয়ে জীবন্ত পুঁতে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিল পাড়া। মায়ের প্রাণ বাঁচাতে তাঁকে শিকলে বেঁধে রেখে রাখতে বাধ্য হয়েছেন ছেলেরাই।
ময়ূরেশ্বরের নবগ্রাম- আদিবাসী পাড়ায় গেলেই দেখা মেলে ৮৬ বছরের হেমি সরেনের। চেয়ারে জুবুথুবু হয়ে বসে। বারান্দার গ্রিলের সঙ্গে তালা দিয়ে চেনে বাঁধা পা। চেনের ঘষটানিতে ঘা হয়ে গিয়েছে পায়ে। প্রশ্ন করতেই অসহায় দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে নিজের মনে বিড়বিড় করতে থাকেন। দু’চোখের দৃষ্টি হারিয়েছেন বহু দিন আগে। বয়সের ভারে তেমন হাঁটা চলাও করতে পারেন না। কথা বলতে গেলে, উত্তর মেলে কেবল দুর্বোধ্য কিছু শব্দে।
ঘটনার সূত্রপাত, মাস তিনেক আগে। প্রাতঃকৃত্য করে ফেরার সময় বৃদ্ধা নিজের বাড়ি ভেবে ঢুকে পড়েছিলেন এক পড়শির উঠোনে। ঘটনাচক্রে সে দিনই ওই পড়শির বাড়িতে এক শিশু অসুস্থ হয়ে পড়ে। বৃদ্ধার মেজ ছেলে মঙ্গল সরেন জানান, ওই শিশুর অসুস্থ হয়ে পড়ার দায় গিয়ে পড়ে মায়ের ওপর। গ্রামবাসীরা এরপরই তাঁকে ‘ফোকোস’ (আদিবাসী ভাষায় ডাইনি) অপবাদ দিয়ে গৃহবন্দি করে পিটিয়ে মারার নিদানও দেয়। হেমি সরেনের এক ছেলে গ্রামের নিদানের প্রতিবাদ করেন। এতে ক্ষিপ্ত গ্রামবাসীরা তাঁকে গ্রামে ‘ঠাকুর থানে’ জীবন্ত পুঁতে দেওয়ার জন্য গর্ত খুঁড়তে শুরু করেন বলে অভিযোগ। মঙ্গলবাবু বলেন, “সে যাত্রায় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যস্থতায় তিনশো টাকা জরিমানা দিয়ে কোনও ক্রমে রেহাই মেলে। তার পর থেকেই মাকে বেঁধে রাখতে বাধ্য হয়েছি।”
বন্দি অবস্থাতেই ভোর থেকে রাত্রি পর্যন্ত কেটে যায় বৃদ্ধার। তিন ছেলেই মাঠে যান কাজে। সামান্য বর্গা জমি চাষ এবং দিনমজুরি করে তাঁদের সংসার চলে। সর্বক্ষণ দেখভালের মতো সময় তাঁদের হাতে থাকে না। নিত্য প্রয়োজনে বৃদ্ধাকে লাঠি নিয়ে একাই যেতে হয় মাঠে। বৃদ্ধার ছোট ছেলে বলাই সরেন বলেন, “দিন রাতের বেশির ভাগ সময় মাঠে থাকি। একা মা ভুল করে অন্যের বাড়ি গিয়ে রোষের মুখে পড়েছিল। আর যাতে তা না হয় এই আশঙ্কায় শিকল দিয়ে বাঁধতে হয়েছে। প্রয়োজন হলে গলায় এক রকম শব্দ করে মা। তখন গিয়ে আমরা চেন খুলে তার প্রয়োজন মেটাই। এ ছাড়া আর উপায় কী!”
শিক্ষার হার বাড়লেও নবগ্রামের আদিবাসী পাড়ায় তিরিশটি পরিবারের কুসংস্কারের নজির এই প্রথম নয়। এর আগেও ‘ডাইন’ আখ্যা দিয়ে এক বিধবা মহিলাকে গ্রাম ছাড়া করা হয়েছিল। এখনও গ্রামে ফিরতে পারেননি তিনি। আদিবাসী সমাজের রীতি অনুযায়ি, কুষ্ঠ রোগে মৃত্যু হলে তাঁর সৎকারে এখনও এই গ্রামের বাসিন্দারা কেউ হাত লাগান না। মৃত স্বামীকে একাই দাহ করেছিলেন এক মহিলা এই নবগ্রামে।
এক সময়ে আদিবাসী পাড়ার পরিবারগুলি অধিকাংশই ছিল সিপিএম সমর্থক। এখন তৃণমূল সমর্থক হিসেবে পরিচিত। গ্রামের অন্য পাড়ায় বসবাস দীর্ঘ দিনের সিপিএমএর পঞ্চায়েত প্রধান মানিক মণ্ডল ও বেলি ভল্লার। বর্তমানে গ্রামের পঞ্চায়তের আসনে জিতেছেন তৃণমূলের মঞ্জু মণ্ডল। কিন্তু পরিবর্তন ঘটেনি আদিবাসী পাড়ার। বাসিন্দারা আটকে রয়েছেন নানা কুপ্রথা এবং কুসংস্কারে। এলাকার প্রাক্তন এবং বর্তমান জনপ্রতিনিধিরা সকলেই জানান, আদিবাসী সমাজকে ওই ধরনের কুসংস্কার থেকে দূরে সরানো খুব কঠিন কাজ। আমরা বিভিন্ন সময়ে চেষ্টা করেও, পারিনি। ময়ূরেশ্বর ২ ব্লকের বিডিও সৈয়দ মাসুদুর রহমান বলেন, “চূড়ান্ত অমানবিক ঘটনা। বিষয়টি জানতাম না। প্রশাসনের তরফে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
ওই বৃদ্ধার পরিবার থেকেই এবার আদিবাসী সমাজের মধ্যে প্রথম মাধ্যমিক পাশ করেছে তার নাতনি সরমনি। বলেন, “ঠাকুমাকে ওই বাঁধা থাকা অবস্থায় দেখতে খুব কষ্ট লাগে। কিন্তু আরও কোনও বড় বিপদের আশঙ্কায় খুব কষ্ট করে সইতে হচ্ছে সব। জানি না, কিভাবে শিকল থেকে মুক্তি মিলবে ঠাকুমার।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy