Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

দূরের তারা, চেনা ডাক্তার আর পুরনো প্রতিশ্রুতি

রোদে ঝলসে যাচ্ছে চারপাশ। নিঝুম দুপুরে তালডাংরায় একতলার ছোট ঘরটার দরজা ভেজানো ছিল। ভিতরে খুব কম ভল্যুমে চলা টিভির সামনে প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ছিল কয়েকটা মুখ। সারদা মামলায় রাজ্যের এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ নিয়ে টিভিতে বিশ্লেষণ চলছে।

এত দিন যেখানেই গিয়েছেন, উপচে পড়া ভিড় হয়েছে। কিন্তু রবিবার কড়া রোদে বাঁকুড়ার কাঞ্চনপুরে মুনমুন সেনের সভায় তেমন ভিড় হল না। অভিজিত্‌ সিংহের তোলা ছবি।

এত দিন যেখানেই গিয়েছেন, উপচে পড়া ভিড় হয়েছে। কিন্তু রবিবার কড়া রোদে বাঁকুড়ার কাঞ্চনপুরে মুনমুন সেনের সভায় তেমন ভিড় হল না। অভিজিত্‌ সিংহের তোলা ছবি।

সোমা মুখোপাধ্যায়
বাঁকুড়া শেষ আপডেট: ২১ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:০১
Share: Save:

রোদে ঝলসে যাচ্ছে চারপাশ। নিঝুম দুপুরে তালডাংরায় একতলার ছোট ঘরটার দরজা ভেজানো ছিল। ভিতরে খুব কম ভল্যুমে চলা টিভির সামনে প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ছিল কয়েকটা মুখ। সারদা মামলায় রাজ্যের এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ নিয়ে টিভিতে বিশ্লেষণ চলছে। উঠোন পেরিয়ে ভিতরে ঢুকলেন বাসুদেব আচারিয়া। সকাল থেকে খান পাঁচেক সভা আর গোটা চারেক গ্রাম ঘোরার পরে ঘণ্টাখানেকের বিশ্রাম বরাদ্দ ছিল তাঁর। তাঁকে ঢুকতে দেখে অন্য মুখগুলো বলে উঠল, “স্যার, আবার সারদা!”

বাঁকুড়া কেন্দ্র থেকে ন’বার জেতা সিপিএম সাংসদের গলাটা তার আগের দিন টেলিফোনে কিছুটা ম্লান শুনিয়েছিল। বলেছিলেন, “ওরা যেখানে পারছে আমাদের কর্মীদের মারছে। দেওয়াল লিখতে দিচ্ছে না। পোস্টার ছিঁড়ছে। বহু গ্রামে ঢোকাই যাচ্ছে না। এই সন্ত্রাসের মোকাবিলা কী ভাবে করবেন আমাদের কর্মীরা?”

২৪ ঘণ্টা পরে সেই তিনিই বললেন, “পাপ কাউকে রেহাই দেয় না। মানুষ সব বুঝছেন। ভোটে সেটারই প্রতিফলন হবে।”

কোন টনিক এত দ্রুত কাজ করল? টিভির দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা মুখগুলো দেখে সেটা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। বাসুদেববাবু বললেন, “এই জেলায় প্রায় ৯০ হাজার বিড়ি শ্রমিক। তার মধ্যে ৫৫ হাজারই আমার নির্বাচনী এলাকায়। বিড়ি বেঁধে রোজ যা আয় করতেন এঁরা, অর্ধেক জমা রাখতেন সারদা-য়। ওঁদের সব গিয়েছে। এমন উদাহরণ আরও আছে। ভোট দেওয়ার সময় এঁরা কি ভুলে যাবেন, এই পাপের শরিক কারা?”

নির্বাচনী সভায় গিয়ে তাই সারদা-মামলাকেই হাতিয়ার করছেন প্রবীণ বাম নেতা। কিন্তু কাদের কাছে?

সে দিন বিকেলেই বাসুদেববাবুর সভা ছিল তালডাংরা থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার ভিতরে পাঁচমুড়া গ্রামে। সিপিএম কর্মীরা জানালেন, তিন বছর পরে সেদিনই প্রথম ওই গ্রামে ঢুকতে চলেছেন তাঁরা। নিরাপত্তারক্ষী পরিবেষ্টিত হয়ে বাসুদেববাবু ঢুকলেন বটে। কিন্তু তাঁর কথা শোনার জন্য হাজির জনা বিশ প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষ আর তিন থেকে দশ বছর বয়সের গোটা পঁচিশেক বাচ্চা। সারদাকাণ্ড, মূল্যবৃদ্ধি, বিদ্যুত্‌ নীতির মতো হাজারো বিষয় নিয়ে তাঁর কথার ফাঁকেই শ্রোতারা উসখুস করছেন। শুনতে ভাল লাগছে না? বছর ত্রিশের যুবক তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বললেন, “এ সব অনেক শুনেছি। কোনও লাভ হয়নি। এখন আবার এ সব শুনছি জানলে অন্য পক্ষের মার জুটতে পারে। তাই বেশিক্ষণ এখানে না থাকাই ভাল।”

আগের বার বাসুদেববাবুর প্রতিশ্রুতি ছিল “বাঁকুড়ায় তিন-তিনটি স্টিল প্ল্যান্ট হবে।” তিন বছরে তার একটিও হয়নি। প্রার্থী দায়ী করেছেন নতুন সরকারের জমিনীতিকে। আর পানীয় জল? গড়ে আশি-নব্বইটি পরিবারের পানীয় জলের জন্য একটিই টিউবওয়েল। স্নান করার জল পেতে হাঁটতে হয় দু’কিলোমিটার। আগের ন’বারের মতো এ বারও বাসুদেববাবু বলছেন, জলের সমস্যা দ্রুতই মিটতে চলেছে। কিন্তু তাঁর কথায় জনতা কতটা বিশ্বাস করবে, বলা কঠিন। বিশেষত তাঁর প্রতিপক্ষকে দেখতে যখন ভিড় উপচে পড়ছে! তা তিনি নিজে যতই তাঁকে ‘অতিথি শিল্পী’ বলুন না কেন!


ক্লিক করুন...

যাঁকে নিয়ে এই খোঁচা, সেই ‘অরাজনৈতিক’ প্রার্থী মুনমুন সেনকে নিয়ে দলের অন্দরেও যথেষ্ট ক্ষোভ রয়েছে। কিন্তু মুনমুনকে এক কথায় উড়িয়েও দিতে পারছেন না কেউ। এমন কী বাসুদেববাবুর মতো পোড় খাওয়া সাংসদও স্বীকার করেছেন, “এ বার কঠিন লড়াই। তাই আমাকেও স্ট্র্যাটেজি বদলাতে হয়েছে।”

কঠিন, কারণ মুনমুনের প্রচারে ঠাসা চমক। নাচ-গান, রিয়া-রাইমার উপস্থিতি তো থাকছেই কখনও কখনও। এর সঙ্গে প্রায় প্রতি সভায় তাঁর আধো-আধো উচ্চারণে থাকছে, “উত্তম-সুচিত্রা বাঙালির রক্তে। আমি সেই সুচিত্রার মেয়ে।” মানুষ হাঁ করে গিলছেন সেই কথা।

গত বার বাঁকুড়া থেকে দাঁড়িয়েছিলেন বিজেপি-র রাহুল সিংহ। কিন্তু ভোটের বাক্সে বিশেষ দাগ কাটেনি তাঁর উপস্থিতি। এ বার বিজেপি প্রার্থী করেছে স্থানীয় স্ত্রীরোগ চিকিত্‌সক সুভাষ সরকারকে। মোদী হাওয়া হোক কিংবা চিকিত্‌সক হিসেবে সুভাষবাবুর জনপ্রিয়তা, বাঁকুড়ায় এ বার বিজেপির অস্তিত্ব অন্য বারের তুলনায় যথেষ্টই চোখে পড়ছে। সুভাষবাবু বললেন, “মানুষ জানেন বিপদে আমাকে পাওয়া যায়। তাই এত বছর সুযোগ পেয়েও যিনি কিছুই করেননি, সেই বাসুদেব আচারিয়া কিংবা ‘ভোটপাখি’ মুনমুন সেনের পাশে না থেকে মানুষ আমার পাশেই থাকবেন, আমার বিশ্বাস।”

এই ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতার পাশে খানিকটা ম্রিয়মান অবস্থা কংগ্রেস প্রার্থী নীলমাধব গুপ্তের। তৃণমূলের তারকা প্রার্থী নিয়ে চাপে? নীলমাধববাবুর জবাব, “কর্মিসভায় গিয়ে যিনি ‘কর্মচারীদের সভা’ বলেন, সেই তারকাকে গ্রামের মানুষ চান না। উনি দূরের তারা হয়েই থাকছেন, কারও কাছের মানুষ হতে পারছেন না।”

বিকেল পাঁচটা। ঘন নীল জর্জেট আর হাল্কা মেকআপে জনসভায় যাওয়ার জন্য হোটেল থেকে বেরোলেন মুনমুন। চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে গাড়িতে উঠলেন ভরত দেববর্মন। জনসভায় দেওয়া মাটির ভাঁড়ের চায়ে তাঁরা স্বামী-স্ত্রী কেউই চুমুক দেন না। এ নিয়েও কথা উঠেছে দলের অন্দরে। স্থানীয় এক নেতা বললেন, “গত বার তৃণমূল সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী সুব্রত মুখোপাধ্যায় দিন-রাত এক করে দিয়েছিলেন বাঁকুড়ায়। আর এ বারের প্রার্থী শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়ি থেকে নামামাত্র মাথায় ছাতা ধরতে হচ্ছে! এ ভাবে জনসংযোগ হয় নাকি?”

মুনমুন অবশ্য বলছেন, ভোটটা মানুষ তাঁকে দেখে দেবে না, দেবে তৃণমূলকে দেখেই। সভায় নিজের পরিচয় জানানোর পাশাপাশি তাই বড়জোর বাচ্চাদের নিয়মিত স্কুলে পাঠানোর উপরে জোর দিচ্ছেন কিংবা পরিবারে মহিলাদের প্রাধান্য বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তার কথা বলছেন।

রাজনীতির ময়দানে সদ্য পা রেখে বিষয়টার বিন্দুবিসর্গ যে তিনি ‘বুঝে উঠতে পারছেন না’ তা প্রতি পদেই স্বীকার করে নিচ্ছেন সুচিত্রা-তনয়া। জানাচ্ছেন, তাঁর কাছে তৃণমূল মানে এখনও মমতা। সিপিএম যে ফের সারদা নিয়ে ময়দানে নামছে, সে কথা মনে করিয়ে দিলে স্পষ্টতই বিরক্ত মুনমুন বলছেন, “ও সব আমাকে বলে লাভ নেই। আমি এর কিচ্ছু জানি না।”

তাঁর এই মনোভাব অস্বস্তি এবং বিরক্তি উদ্রেক করেছে স্থানীয় তৃণমূল নেতা-কর্মীদের একাংশের মনে। এক নেতার কথায়, “উনি কিছু বুঝছেন না, বোঝার চেষ্টাও করছেন না। মঞ্চে উঠে শুধু নিজের মায়ের কথা বলে আর মমতাদি কী ভাবে ওঁদের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, সে কথা বলে কি ভোট চাওয়া যায়?”

বাঁকুড়ায় মুনমুনের ভোট কাটার ক্ষেত্রে সিপিএমের অন্যতম ভরসা তৃণমূলের এই ‘গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব’। যার কিছুটা আঁচ মুনমুন নিজেও পেলেন ধুলাডিহি গ্রামের জনসভায়। বিদ্যুত্‌ ছিল না, তাই জেনারেটরের ব্যবস্থা হয়। সভা শুরুর সময় দেখা গেল সেই জেনারেটরও বিকল। খোলা মাঠে গাঢ় অন্ধকারে দাঁড়িয়ে মাইক ছাড়াই দু’চার কথা বলে ফিরে আসতে হল তাঁকে। ততক্ষণে পারস্পরিক দোষারোপের পালা তুঙ্গে। নেতারা মানলেন, দলের ভিতরেই কোনও একটা ‘ষড়যন্ত্র’ হয়েছে।

প্রার্থীর কপালেও চিন্তার ভাঁজ। এমন অভিজ্ঞতা তাঁর কাছে নতুন। তবে বেশি মাথা ঘামাতে রাজি নন। যদি এ বার না জেতেন তা হলে যে ভবিষ্যতে এই চত্বরে আর তাঁকে দেখা যাবে না, সেটা স্পষ্টই জানিয়েছেন মুনমুন। বলেছেন, “হেরে গেলে বুঝব এটা আমার জায়গা নয়। ব্যস, দ্যাটস ইট।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

election campaign soma mukhopadhay bankura
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE