Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

পক্ষ হোক বা প্রতিপক্ষ, সবার মুখেই কেষ্ট-নাম

রবীন্দ্রনাথ...অমর্ত্য...সোমনাথ...অনুব্রত...।শহরের রাজপথ চিরে রিকশা চালাচ্ছিলেন শেখ টারজান।রবীন্দ্রনাথের নাম শুনেছেন? টারজান ঘাড় ঘুরিয়ে সওয়ারিকে দেখে নেন। বলেন, “হ! চিনি! মানুষ নয়, ঠাকুর ছিল! ও ছিল বলেই তো এই শান্তিনিকেতন! আমরাও রিকশা চালিয়ে দু’মুঠো খেতে পাচ্ছি?”

সুনন্দ ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:৪৪
Share: Save:

রবীন্দ্রনাথ...অমর্ত্য...সোমনাথ...অনুব্রত...।

শহরের রাজপথ চিরে রিকশা চালাচ্ছিলেন শেখ টারজান।

রবীন্দ্রনাথের নাম শুনেছেন? টারজান ঘাড় ঘুরিয়ে সওয়ারিকে দেখে নেন। বলেন, “হ! চিনি! মানুষ নয়, ঠাকুর ছিল! ও ছিল বলেই তো এই শান্তিনিকেতন! আমরাও রিকশা চালিয়ে দু’মুঠো খেতে পাচ্ছি?”

অমর্ত্য সেন? “ও তো বাইরে থাকে। ওর কথা শুনেছি।”

সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়? “হ। চিনি তো! ছিপিএন ছিল!”

অনুব্রত মণ্ডল? এ বার সতর্ক টারজান। একটু থেমে পাল্টা প্রশ্ন, “আপনি কে বটে?”

পরিচয় দিতেই ঠোঁটে হালকা হাসি ঝুলিয়ে টারজান বলেন, “মজা করছেন নাকি! উ-কে চেনে না এই এলাকায় ক’টা মানুষ আছে! উরিব্বাবা! খুব বড় নেতা বটে!”

ভোটের বাজারে কিছু ইংরেজি শব্দের সঠিক বাংলা হয় না। যেমন ‘ফ্যাক্টর’। বোলপুর লোকসভা কেন্দ্রের নির্বাচনে এ বার সেই ফ্যাক্টরটা কে বলার জন্য ভোট-বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার নেই। শহরের দামাল ছেলে থেকে গ্রামের স্কুলছুট, সকলেই জানে সেই ফ্যাক্টরের নাম, অনুব্রত (কেষ্ট) মণ্ডল। দেব-মুনমুন-বাবুল-সন্ধ্যা-ইন্দ্রনীলদের বাজারে যিনি প্রার্থী না হয়েও ছিনিয়ে নিয়েছেন প্রচারের অনেকটা আলো।

ভোটের আগে গ্রাম-গঞ্জে যে ছবি দেখতে অভ্যস্ত ছিল চোখ, সেই লাল পতাকার দাপট উধাও। এক সময়ে বাম-বিরোধী রাজনীতি করার জন্য যেমন পড়ে পড়ে মার খেতে হয়েছে, এখন সেই একই অভিযোগের উল্টো ছবি। শহরের মায়াজাল পেরিয়ে অনেক সময়েই এই মার-খাওয়া মানুষদের পাশে পৌঁছতে পারেন না নেতা-নেত্রীরা। দলের উপরেই ক্ষোভ জন্মায় কর্মী-সমর্থকদের। লালমাটির এই দেশও তার ব্যতিক্রম নয়।

দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে এই কেন্দ্রে জিতে আসা বাম প্রার্থী সোমনাথবাবু লোকসভায় স্পিকার হয়েছেন। শহরের শিক্ষিত মানুষের পছন্দের প্রার্থী তিনি। বিশ্বভারতীর শিক্ষক, প্রবীণ সুখেন্দুকৃষ্ণ মজুমদারের কথায়, “এখনও বোলপুরে এসে সোমনাথবাবু দাঁড়ালে তাঁর চারপাশে ভিড় জমে যায়।” কিন্তু গ্রামের খেত থেকে উঠে আসা, মাটি-মাখা আদুড় গায়ের যুবকের কাছে ব্যারিস্টার সোমনাথবাবুরা আসলে দূরের মানুষ। উল্টে ড্রয়িং রুমে বসে যে ‘মারমুখী’ ভাষণ শুনে ভুরু কুঁচকে যায় শহুরে মানুষের, কেষ্টদার সেই কথাগুলোই গ্রামের মানুষদের বড় আপন লাগে।

গত বার জিতেছিলেন সিপিএমের রামচন্দ্র ডোম। ১ লক্ষ ২৮ হাজার ভোটে। সে বার নানুর-সহ বিস্তীর্ণ এলাকায় সাধারণ মানুষ ভোট দিতে পারেননি, এমন অভিযোগ ছিল। রামচন্দ্রবাবু পেশায় চিকিৎসক। জেতার পরে গত পাঁচ বছরে তাঁকে গ্রাম-গঞ্জে বিশেষ দেখা যায়নি, সাদা তোয়ালের সঙ্গে সেই অভিযোগও ঝুলছে তাঁর কাঁধে। ময়ূরেশ্বরের পাথাই গ্রামে দেখা পাওয়া গেল তাঁর। তেঁতুল গাছের তলায় ছোট্ট সভা। সামনে কয়েক জন মহিলা-পুরুষ-বাচ্চা। সেখানে ঘরোয়া পরিবেশের সভাতেও এক জন উঠে সভাপতির নাম ঘোষণা করলেন, আর এক জন সঙ্গে সঙ্গে ‘সর্বান্তঃকরণে’ তা সমর্থন করলেন। গতে বাঁধা নিয়ম। ধানের সহায়ক মূল্য না-পাওয়া, নারী নির্যাতন ছিল ভাষণ জুড়ে। রামের মুখে কেষ্টও ছিলেন। তিনি যে ‘ফ্যাক্টর’।

পাড়ুই গ্রামে সাগর ঘোষের বাড়ি থেকে কীর্ণাহারের হোটেল, আলোচনায় উঠে আসছে তাঁরই নাম। কোথাও কড়া সমালোচনা, কোথাও ভিলেন, কোথাও কাছের মানুষ।

মাত্র ৩১ বছরের অনুপম হাজরাকে প্রার্থী করে রথের রাশ তুলে নিয়েছেন নিজের হাতে। দুর্জনে বলে, শিখণ্ডী খাড়া করে লড়ছেন কেষ্ট। কেউ আবার কুরুক্ষেত্রে অর্জুনের সারথি কৃষ্ণের কথাও মনে করিয়ে দিয়েছেন।

সেই অনুব্রতর কথা প্রদীপ ভট্টাচার্যের মুখেও। বোলপুরে কংগ্রেসের কর্মিসভায় কলকাতা থেকে এসেছিলেন প্রদেশ কংগ্রেসের প্রাক্তন সভাপতি। ৬১ বছরের কংগ্রেস প্রার্থী তপন সাহার পরিচিতির গণ্ডি বোলপুর শহর ছাড়িয়ে বিশেষ নেই। ফিসফিস করে বললেন, “আমি পুরসভার চেয়ারম্যান ছিলাম তিন বছর। সাইকেলে চেপে ঘুরে ঘুরে বৈঠক করেছি।” সেই ইমেজ নিয়ে তাকিয়ে রয়েছেন দলের কর্মীদের দিকে। প্রদীপবাবুকে ডেকেছিলেন দলীয় কর্মীদের উদ্বুদ্ধ করতে। প্রদীপবাবুর বক্তৃতাতেও বিজেপি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে উচ্চারিত হয়েছে অনুব্রতর নাম। তিনিই যে ‘ফ্যাক্টর’।

তিন দিন ধরে বোলপুর কেন্দ্রে পড়ে থেকে, পাড়ুই-নানুর-লাভপুর-ময়ূরেশ্বর-মঙ্গলকোট-আউশগ্রাম ঘোরার ফাঁকে সেই ফ্যাক্টরের কাছে পৌঁছনোর জন্য বিস্তর কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। এই প্রচেষ্টার মাঝে কলকাতার বন্ধুবান্ধব ‘সাবধান’ও করে দিয়েছেন, “দেখিস বাবা!” যেন কাছে গেলে তিনি ধাঁই করে বোমা মেরে দিতে পারেন! তিন দিন তিনি ফোন ধরেননি। নিরাপত্তারক্ষী ফোন ধরে বলেছেন, “দাঁড়ান, দিচ্ছি।” পরক্ষণেই আবার বলেছেন, “দাদা তো এই মাত্র বেরিয়ে গেলেন!” গেছোদাদার মতো, শোনা গিয়েছে তিনি কখনও কলকাতায়, কখনও কঙ্কালীতলায়।

অনুপম হাজরা বেশ সপ্রতিভ। চোখে-মুখে ঝকঝকে ভাব। পেটানো চেহারা। ছটফটে। দুপুরে রেস্তোঁরার টেবিলে উল্টো মুখে বসে অনেক ক্ষণ কথা বললেন। কাল জিতলে পরশু দিন থেকেই কাজ করতে নেমে যাবেন, ভাবটা এমনই। অনুরোধ মেনে তিনিও সামনে বসে ফোন করেন কেষ্টকাকাকে। কিন্তু সেকেন্ড কুড়ি কথা বলার পরে তাঁরও মুখ থেকে সরে গিয়েছে আলো। বোঝা গিয়েছে, সাংবাদিকের সঙ্গে দেখা করতে চান না অনুব্রত। তাঁর ঘনিষ্ঠ এক জনের বক্তব্য, “যদি আবার বেফাঁস কিছু বলে দেন, তাই তাঁকে উপর থেকে বারণ করা হয়েছে।”

শেষ পর্যন্ত সেই অনুব্রতকে সকাল সকাল পাওয়া গিয়েছে বোলপুরের বাড়িতে। কোথায় সেই মারমুখী মেজাজ! কোথায় সেই পালিয়ে যাওয়ার মানসিকতা! বুক চিতিয়ে বসে রয়েছেন বাড়ির দাওয়ায়। হাতে বোমা নয়, লাল চায়ের গ্লাস। সাদা রঙের লুঙ্গি, গোলগলা হলুদ-টি। পাশে অনুপম। মুখে এক চিলতে হাসি দেখে মনে হচ্ছে, যুদ্ধ জয় সেরেই ফেলেছেন। খোশমেজাজে গল্প করলেন কিছুক্ষণ। বললেন পড়াশোনা নয়, খেলাধুলোয় মন ছিল বেশি। ছোটবেলায় গোলকিপিং করতেন। এখন রাতে অক্সিজেন-মাস্ক নিয়ে শুতে যান।

বাম রাজনীতি করা বেশ কিছু ক্ষুরধার বুদ্ধির মানুষকে পাশে পেয়েছেন অনুব্রত। মুখে বলছেন দেড় লক্ষ ভোটে জেতার কথা। কিন্তু কাঁটাও রয়েছে বিস্তর। নানুর, লাভপুর-সহ জেলার সর্বত্র জুড়ে দাদাগিরির অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে। পাড়ুই-এর বাড়িতে গেলে সাগর ঘোষের ছেলে হৃদয়বাবু গুলির দাগ দেখান। অনুব্রতর হম্বি-তম্বি এবং একাধিপত্যে জর্জরিত কাজল শেখের মতো প্রভাবশালী তৃণমূল নেতা। নানুরে তাই তৃণমূলের বিরোধী তৃণমূলই।

মঙ্গলকোটে শ্যামবাজার বলে একটা জায়গা আছে। সেখানে দেখা বিজেপির প্রার্থী কামিনীমোহন সরকারের সঙ্গে। ১৯৭৯-র ব্যাচের ডব্লিউবিসিএস অফিসার। এডিএম হয়ে অবসর নিয়েছেন। ঘোর ঈশ্বর-বিশ্বাসী। কথা বলেন আস্তে। রাজনৈতিক নেতা বলতে যে দাপটের কথা মাথায় আসে, তার একশো যোজন দূর দিয়ে হাঁটেন তিনি। বোলপুর কেন্দ্রের অধীনে ময়ূরেশ্বর, মঙ্গলকোটে বিজেপির বেশ কিছু ভোটার আছে। তার উপরে পাকা বোরো ধানের উপর দিয়ে বইছে মোদী-হাওয়া। মুখে স্মিত হাসি নিয়ে সেই হাওয়ায় গা ভাসিয়েছেন কামিনীবাবু। বাম জমানায় তাঁর উপরে কী কী অবিচার-অনাচার হয়েছে, তা কেউ শুনতে চাইলে খুশি মনে বলছেন। দলের নেতারা আগলে আগলে রাখছেন।

গর্বভরে বলেন, “লোক মারফত অনুব্রতবাবুও অফার দিয়েছিলেন। আমি না করে দিয়েছি।”

সেই অনুব্রত ফ্যাক্টর!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Bolpur General Election
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE