Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

পুরুলিয়ায় মিলল শঙ্খলিপির লেখ

শঙ্খলিপিতে খোদিত বিরল লেখ-র নমুনা মিলল পুরুলিয়ার সাঁতুড়ি থেকে। বিশ্রামজোড় নামে একটি খালের পাশে ধুলুরি গ্রামে পাথরের উপরে আলঙ্কারিক সিদ্ধমাত্রিকা হরফে সংস্কৃত ভাষায় লেখা লেখ-টিতে কেবল ‘শ্রীযুবরাজ’ শব্দটি পড়া যাচ্ছে। চারটি পঙ্ক্তিতে লেখা অষ্টম শতকের এই লেখ-র আর কোনও শব্দের এখনও পাঠোদ্ধার করা যায়নি।

বিশ্রামজোড়ের ধারে পাওয়া গিয়েছে এই শিলালিপি।  —নিজস্ব চিত্র

বিশ্রামজোড়ের ধারে পাওয়া গিয়েছে এই শিলালিপি। —নিজস্ব চিত্র

অলখ মুখোপাধ্যায় ও শুভ্রপ্রকাশ মণ্ডল
কলকাতা ও পুরুলিয়া শেষ আপডেট: ২১ অগস্ট ২০১৪ ০২:১৭
Share: Save:

শঙ্খলিপিতে খোদিত বিরল লেখ-র নমুনা মিলল পুরুলিয়ার সাঁতুড়ি থেকে। বিশ্রামজোড় নামে একটি খালের পাশে ধুলুরি গ্রামে পাথরের উপরে আলঙ্কারিক সিদ্ধমাত্রিকা হরফে সংস্কৃত ভাষায় লেখা লেখ-টিতে কেবল ‘শ্রীযুবরাজ’ শব্দটি পড়া যাচ্ছে। চারটি পঙ্ক্তিতে লেখা অষ্টম শতকের এই লেখ-র আর কোনও শব্দের এখনও পাঠোদ্ধার করা যায়নি।

ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের প্রাক্তন মহা অধিকর্তা গৌতম সেনগুপ্তের বক্তব্য, “ছোট নাগপুর উপত্যকার পুব দিকে পুরুলিয়া, বাঁকুড়া এবং বর্ধমান ও মেদিনীপুরের পশ্চিম দিকের এই অঞ্চলে প্রাচীন লেখ প্রায় অজ্ঞাত। সেক্ষেত্রে এই আবিষ্কার বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।”

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক রজত সান্যাল জানান, যে লিপিতে এই লেখ-টি রচনা করা হয়েছে, তা শঙ্খলিপিরই একটি সংস্কার করা রূপ। পশ্চিমবঙ্গে এর আগে শঙ্খলিপিতে রচিত লেখ কেবল পাওয়া গিয়েছে বাঁকুড়ার শুশুনিয়ার পাহাড়ের গায়ে। চন্দ্রবর্মার লেখ-র ঠিক পাশেই পাওয়া গিয়েছিল সেই লেখ-টি। লেখ-টির বয়স আনুমানিক ষষ্ঠ শতাব্দীর বলে অনুমান করা হয়। সাঁতুড়ির লেখ-টি অষ্টম শতাব্দীর বলে মনে করছেন রজতবাবু। অষ্টম শতকের পূর্ব ভারতীয় সিদ্ধমাত্রিকা লিপিতে শব্দের প্রতিটি অক্ষরের মাথায় ত্রিভুজাকার মাত্রা পাওয়া যায়। এখানেও সেই বৈশিষ্ট্য দেখা গিয়েছে। সেই সঙ্গে শঙ্খলিপির বৈশিষ্ট্য মেনে অক্ষরগুলির সঙ্গে আলঙ্কারিক রেখাও যুক্ত হয়েছে।

বাংলাদেশের কুমিল্লা, নোয়াখালি অঞ্চল থেকে এর আগে অষ্টম শতকের একাধিক লেখ পাওয়া গেলেও পশ্চিমবঙ্গে ওই শতকের আর কোনও লেখ-র নিদর্শন এখনও পর্যন্ত মেলেনি। বাংলাদেশের লেখগুলিও পাথরের উপরে নয়, তামার পাতের উপরে লেখা। তা ছাড়া, সেগুলিও পূর্ব ভারতীয় সিদ্ধমাত্রিকায় রচিত। শঙ্খলিপির বৈশিষ্ট্য শুশুনিয়ার পরে কেবল সাঁতুড়িতেই পাওয়া গেল। সেই সঙ্গে, শুশুনিয়ার পরে প্রাক ইসলামিক যুগের ক্যালিগ্রাফিক বা আলঙ্কারিক লিপিশৈলির আরও একটি উদাহরণ হিসেবেও সাঁতুড়ির লেখ-টি গুরুত্বপূর্ণ।

ব্রাহ্মীর একটি বিবর্তিত রূপ শঙ্খলিপি। যদিও শঙ্খলিপির প্রকৃত উৎস আজও বিতর্কিত। মধ্য ভারত থেকে উত্তরভারত ও পূর্ব বিহার এবং শুশুনিয়া পর্যন্ত বিরাট অঞ্চলে খ্রিস্টীয় চতুর্থ-পঞ্চম শতক থেকে সপ্তম শতক পর্যন্ত সময়ের মধ্যে শঙ্খলিপিতে লেখা লেখ-র নমুনা মিলেছে।

কিন্তু খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকের পরে এই লিপির আর কোনও নমুনা না থাকায়, এর আকস্মিক হারিয়ে যাওয়ার কারণটিও অজানা। সুতরাং, ধুলুরি গ্রামে শঙ্খলিপির এই নতুন নিদর্শন লিপিটির কালানুক্রম সম্পর্কেও নতুন আলো ফেলবে বলে লিপিতত্ত্ববিদেরা আশা করছেন।

‘শ্রীযুবরাজ’ শব্দটির পাঠোদ্ধার করেছেন রজতবাবু। তবে লেখ-টির সম্পূর্ণ পাঠোদ্ধার করা যায়নি বলে তাতে ঠিক কী বলা রয়েছে, তা জানা যাচ্ছে না। খালের ধারে বিরাট পাথরের পাড়ের এক কোণে পাওয়া গিয়েছে এই লেখ-টি। প্রাথমিক ভাবে পুরাতত্ত্ববিদদের অনুমান, লেখ-টি জমির লেনদেন সম্পর্কিত নয়।

তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতত্ত্ব দফতরের শিক্ষিকা বিষ্ণুপ্রিয়া বসাকের বক্তব্য, শুধু ‘শ্রীযুবরাজ’ কথাটিও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, তা থেকে বোঝা যাচ্ছে, জঙ্গলমহল লাগোয়া ওই এলাকায় সেই সময়ে কোনও না কোনও স্থানীয় রাজশক্তির অস্তিত্ব ছিল। দশম শতাব্দীর আগে পুরুলিয়ার ইতিহাস সম্পর্কে এমন পাথুরে প্রমাণও আগে মেলেনি। পুরাতত্ত্ববিদ গৌতমবাবুর বক্তব্য, এই লেখ পাওয়ার পরে এ বার তাই ওই অঞ্চলের সার্বিক প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত খুঁটিয়ে দেখার প্রয়োজন রয়েছে।

তবে পুরুলিয়া শহর থেকে ৮০ কিলোমিটারের মতো দূরের ধুলুরি গ্রাম থেকে এই এলাকার এক প্রাচীন প্রত্নক্ষেত্র তৈলকম্প বা তেলকুপি মাত্র ৬০ কিলোমিটার। সেখানে দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকের লেখ ও মন্দিরও পাওয়া গিয়েছে। শুশুনিয়া পাহাড়ের দূরত্বও ধুলুরি থেকে মাত্র ৫৫ কিলোমিটার। ধুলুরির লেখ-টির খোঁজ স্থানীয় বাসিন্দা শিক্ষক মাধব মণ্ডলই প্রথমে প্রশাসনকে দেন। তিনি বলেন, “এই গোটা অঞ্চলে প্রাচীন জনবসতি ছিল বলেই অনুমান করি। এ বার সরকারি পর্যায়ে অনুসন্ধান শুরু হলে তা ধরা পড়বে।”

মাধববাবুর কাছ থেকে খবর পেয়ে সাঁতুড়ির বিডিও দিব্যেন্দুশেখর দাস লেখ-টি সম্পর্কে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে জানান। লেখ-টি সম্পর্কে উৎসাহী হয়েছে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণও। বুধবার সর্বেক্ষণের একটি প্রতিনিধি দল ধুলুরি যান।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE