Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

বুক চিতিয়ে লড়েই শহিদ বিকাশ

অভিযানে সামনে থেকেই বুক চিতিয়ে লড়ে যাচ্ছিলেন। গায়ে ছিল বুলেট প্রুফ জ্যাকেট। তা সত্ত্বেও হঠাৎই পাহাড়ের উপরে থাকা মাওবাদীদের ছোড়া গুলি কোনও ভাবে তাঁর দেহে বিঁধে যায়। একটি বুকের উপরের দিকে, অন্যটি ঘাড়ে। প্রায় একই সময় গুলি খেয়ে পড়ে যান তাঁরই পিছনে থাকা বাহিনীর ডেপুটি কমান্ডান্ট। দুই জখমকে হেলিকপ্টারে চাপিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে। কিন্তু মাঝপথেই প্রাণ হারান কোবরা বাহিনীর জওয়ান বিকাশ সূত্রধর (২৭)।

গ্রামে এল দেহ। বৃহস্পতিবার তোলা নিজস্ব চিত্র।

গ্রামে এল দেহ। বৃহস্পতিবার তোলা নিজস্ব চিত্র।

মহেন্দ্র জেনা
পাড়ুই শেষ আপডেট: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০২:১৭
Share: Save:

অভিযানে সামনে থেকেই বুক চিতিয়ে লড়ে যাচ্ছিলেন। গায়ে ছিল বুলেট প্রুফ জ্যাকেট। তা সত্ত্বেও হঠাৎই পাহাড়ের উপরে থাকা মাওবাদীদের ছোড়া গুলি কোনও ভাবে তাঁর দেহে বিঁধে যায়। একটি বুকের উপরের দিকে, অন্যটি ঘাড়ে। প্রায় একই সময় গুলি খেয়ে পড়ে যান তাঁরই পিছনে থাকা বাহিনীর ডেপুটি কমান্ডান্ট। দুই জখমকে হেলিকপ্টারে চাপিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে। কিন্তু মাঝপথেই প্রাণ হারান কোবরা বাহিনীর জওয়ান বিকাশ সূত্রধর (২৭)।

পশ্চিম মেদিনীপুরের বেলপাহাড়ি থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে ঝাড়খণ্ডের পূর্ব সিংভূম জেলার ঘাটশিলা থানার চেকাম জঙ্গলে বুধবার সকালে মাওবাদীদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় যৌথ বাহিনীর। ওই সংঘর্ষেই নিহত হন বীরভূমের পাড়ুই থানার বনশঙ্কা গ্রামের ছেলে বিকাশ। বৃহস্পতিবার তাঁর নিথর দেহ ফিরতেই বীর সন্তানকে আরও বেশি আপন করে নিলেন যেখানকার বাসিন্দারা।

এ দিন সকাল ৯টা নাগাদ সেনা বাহিনীর গাড়িতে সিআরপি-র ২০৭ নম্বর ব্যাটেলিয়ানের কোবরা বাহিনীর শহিদ জওয়ান বিকাশের দেহ পাড়ুইয়ে তাঁর গ্রামের বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। ততক্ষণে অবশ্য প্রিয় টোটোনকে (বিকাশের ডাকনাম) দেখতে ছুটে এসেছেন আশেপাশের কয়েক হাজার মানুষ। সত্তরোর্ধ্ব প্রৌঢ় থেকে কোলে শিশু মা, হাজির সকলেই। বনসঙ্কা উচ্চ বিদ্যালয় যাওয়ার সামনের রাস্তায় তখন শুধুই মাথা। জনতার ভিড় রাস্তার দখল নিয়েছে। তার মধ্যে দিয়েই কোনও মতে জাতীয় পতাকায় মোড়া বিকাশের দেহ নিয়ে আসা হয়। স্কুলের ভেতরেই শহিদ জওয়ানকে ‘গার্ড অফ অনার’ দেওয়া হয়। তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে সকাল থেকেই সেখানে হাজির ছিলেন জেলা পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়া, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আনন্দ রায়, মহকুমাশাসক অরুন্ধতী ভৌমিক, জেলা পরিষদের সভাধিপতি বিকাশ রায়চৌধুরী প্রমুখ। তাঁদের সঙ্গেই নিহত জওয়ানের দেহে মাল্যদান করেন সিআরপি ১৬৭ ব্যাটেলিয়ানের কমান্ডান্ট ঘনশ্যাম বেহওয়াল।

শেষ স্নেহ। ঝাড়খণ্ডের জঙ্গলে মাওবাদীদের সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত কোবরা জওয়ান বিকাশ সূত্রধরের
কফিনবন্দি দেহ ফিরল বীরভূমের পাড়ুইয়ের বনশঙ্কা গ্রামে। বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরীর তোলা ছবি।

এর পরেই বিকাশের বাড়িতে দেহ নিয়ে যাওয়া হয়। ছেলের মৃত্যুর খবর পেয়ে বুধবার বিকেল থেকে সমানে কেঁদে চলেছেন মা মিনতিদেবী। রাতেই শালবনি ক্যাম্প থেকে চলে এসেছিলেন বিকাশের স্ত্রী ইতিদেবী। দেহ আসার খবরে বাড়ির শোকের বাতাবরণ আরও কয়েকগুন বেড়ে যায়। শ্বশুরবাড়ির লোকজন, পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়দের মাঝে বাড়ির উঠোনেই বিকাশের নিথর দেহ রাখা হয়। আছড়ে পড়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন মিনতিদেবীরা। বাড়িতে ভিড় বাড়তে থাকায় সঙ্গী জওয়ানেরা কাঁধে করে গ্রামের ন’পুকুর পাড়ে মুখাগ্নি তলায় দেহ সরিয়ে আনেন। সেখানে জওয়ানদের ঘিরে জনতাদের বুধবারের ঘটনা নিয়ে হাজারো প্রশ্ন। ঠিক কী হয়েছিল? এক জওয়ান বললেন, “দেশ কে লিয়ে জান কুরবান।” বিশদে জানালেন ঘনশ্যামবাবু। তাঁর মুখ থেকে জানা যায়, বুধবার কাকভোরে যৌথ বাহিনীর অভিযান শুরু হয়েছিল। অবস্থানগত সুবিধা নিয়ে মাওবাদীরা পাহাড়ের উপর থেকে গুলি চালায়। তখন ঘটনাটি ঘটে। তাঁর কথায়, “বিকাশ সামনেই ছিলেন। তাঁর পিছনেই কোবরা বাহিনীর ডেপুটি কমান্ডান্ট অলোক আনন্দ। দু’জনেরই দু’টি করে গুলি লাগে। বুলেট প্রুফ জ্যাকেটের সামান্য উপরে বুকের কাছে একটি এবং ঘাড়ের কাছে বিকাশের গুলি লাগে।” হেলিকপ্টারে করে দুই গুরুতর জখমকে রাঁচি পাঠানো হলে চিকিৎসকেরা বিকাশকে বলে জানান।

এ দিনই বিকাশের প্রথম বিবাহ বার্ষিকী ছিল। তার কয়েক দিন পরেই দুর্গাপুজো। সব কিছুর জন্য জামাই বাড়িতে এলেই বেশ কিছু জিনিস কেনাকাটা করে রেখেছিলেন ওই জওয়ানের শ্বশুর সত্যনারায়ণ সাধু। কান্নায় ভেঙে পড়া স্বামীর পাশে দাঁড়িয়ে তাঁর স্ত্রী চায়নাদেবী বললেন, “টোটোন মেয়েকে ভালবাসত। আগের বছরই ওদের বিয়ে দিলাম। এখন কী বলে মেয়েকে সান্ত্বনা দেব জানি না।” দেহ আসার পর থেকেই বিকাশের স্ত্রী ও মা বারবার জ্ঞান হারাচ্ছিলেন। মুখাগ্নি তলা থেকে স্বামীর কফিন বন্দি দেহ শেষবার দেখে ফেরার পথে বিড় বিড় করে ইতিদেবী বলছিলেন, “কেন উঠছে না। কেউ ওকে তুলে ওঠাও। ও কেন সাড়া দিচ্ছে না।” জওয়ানেরা দেহ নিয়ে বক্রেশ্বর শ্মশানের দিকে এগোতেই ডুকরে কেঁদে উঠলেন মা। চিৎকার করে বলেলন, “কে আছো। ওকে ফিরতে বলো। ওরা আমার টোটোনকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? তোমরা কেন কেউ কিছু বলছো না!” গাড়ি মিলিয়ে যেতেই আরও একবার জ্ঞান হারালেন শহিদ জওয়ানের স্ত্রী।

অন্য দিকে, এ দিনই নিহত ওই জওয়ানের পরিবারের একজনকে হোমগার্ডের চাকরি দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে রাজ্য সরকার। এ কথা জানিয়েছেন পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার ভারতী ঘোষ। তিনি বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী আমাকে জানিয়েছেন, নিহত জওয়ানের পরিবারের একজনকে হোমগার্ডের চাকরি দেওয়া হবে। রাজ্য সরকার পরিবারকে দু’লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণও দেবে।” ঝাড়খণ্ডের ওই ঘটনায় চিন্তা বেড়েছে রাজ্য পুলিশেরও। ঘটনাস্থল থেকে মাওবাদী প্রভাবিত পশ্চিম মেদিনীপুরের বেলপাহাড়ি ও পুরুলিয়ার বান্দোয়ান থানার দূরত্ব ৫- ৬ কিলোমিটার। পরিবর্ত পরিস্থিতিতে রাজ্যের ঝাড়খণ্ড সীমানাবর্তী এলাকায় অতিরিক্ত সতর্কতা জারি করা হয়েছে। ভারতীদেবীর কথায়, “বর্ডারে হাই অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE