Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

মমতার পথে উদ্ধার বিস্ফোরক, পিটুনিতে হত বাম-কর্মী

মুখ্যমন্ত্রীর সভায় যাওয়ার অন্যতম রাস্তায় শুক্রবার পাওয়া গেল বিস্ফোরক। আর ওই ঘটনার জেরে বেদম মারধরে প্রাণ গেল সিপিএম কর্মী শেখ হীরালালের (৪০)। বীরভূমের নলহাটি ও সিউড়িতে এ দিন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্বাচনী জনসভা ছিল। কপ্টারে চেপে তিনি নলহাটি থেকে পৌঁছেন সিউড়িতে।

এ ভাবেই বিস্ফোরকটি তুলে আনা হয়। —নিজস্ব চিত্র।

এ ভাবেই বিস্ফোরকটি তুলে আনা হয়। —নিজস্ব চিত্র।

দয়াল সেনগুপ্ত
সিউড়ি শেষ আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:৩৮
Share: Save:

মুখ্যমন্ত্রীর সভায় যাওয়ার অন্যতম রাস্তায় শুক্রবার পাওয়া গেল বিস্ফোরক। আর ওই ঘটনার জেরে বেদম মারধরে প্রাণ গেল সিপিএম কর্মী শেখ হীরালালের (৪০)।

বীরভূমের নলহাটি ও সিউড়িতে এ দিন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্বাচনী জনসভা ছিল। কপ্টারে চেপে তিনি নলহাটি থেকে পৌঁছেন সিউড়িতে। রাজ্য পুলিশের এক কর্তা জানান, কোনও কারণে সিউড়িতে কপ্টার খারাপ হয়ে গেলে রাত্রিবাসের জন্য মুখ্যমন্ত্রীকে সিউড়ি বা বোলপুরে নিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। সে ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হতে পারত সিউড়ি থেকে বোলপুরগামী পিচ রাস্তা। সিউড়ির সভা শুরু হওয়ার কিছু আগে ওই রাস্তাতেই সিউড়ি ২ ব্লকের সলখানা গ্রামের কাছে কালভার্টের নীচে উদ্ধার হয় বিস্ফোরক।

সেই বিস্ফোরক। —নিজস্ব চিত্র।

বিস্ফোরক মেলার সময় ওই পথ দিয়েই মোটরবাইকে যাচ্ছিলেন স্থানীয় কেন্দুয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের সিপিএম প্রধান শেখ আনারুলের ভাই, এলাকার সক্রিয় সিপিএম কর্মী শেখ হীরালাল। তাঁর বাড়ি কেন্দুয়ার হাড়াইপুর-ডাঙালপাড়ায়। স্থানীয় সিপিএম নেতা শেখ মকিমের অভিযোগ, “হীরালালকে মোটরবাইক থেকে নামিয়ে বেধড়ক মারধর করে তৃণমূলের লোকেরা। মাথায় গুরুতর আঘাত নিয়ে ওকে প্রথমে সিউড়ি সদর হাসপাতাল ও পরে বর্ধমান মেডিক্যালে স্থানান্তর করা হয়।” সিপিএমের দাবি, অবস্থার অবনতি হওয়ায় কলকাতার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে রাতে মারা যান হীরালাল।

ঘটনাচক্রে এ দিন নলহাটির সভায় ফের তাঁকে খুনের চক্রান্তের অভিযোগ তুলেছেন মমতা। বলেছেন, “আমাকে খুনের পরিকল্পনা চলছে। বিজেপি, কংগ্রেস, সিপিএম কোথাও মাইক টেনে নিচ্ছে, কোথাও বোমা বিস্ফোরণ হচ্ছে। জেনে রেখে দিন, আপনারা যত আমাকে খুন করতে চাইবেন, আমি ডবল করে মানুষের মধ্যে জন্ম নেব!”

বৃহস্পতিবার মুখ্যমন্ত্রী মালদহ শহরের বেসরকারি হোটেলের যে ঘরে ছিলেন, তার এসি মেশিন হঠাৎ ফেটে ধোঁয়া বেরিয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গেই ওই হোটেলে ছিলেন পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র। সিউড়ির ঘটনা সম্পর্কে মদনবাবুর প্রতিক্রিয়া, “বৃহস্পতিবার রাতে মুখ্যমন্ত্রীর হোটেলের ঘরে হল বিস্ফোরণ। আর শুক্রবার মুখ্যমন্ত্রীর সভাস্থল থেকে কিছুটা দূরে পাওয়া গেল বিস্ফোরক। এর থেকেই স্পষ্ট, মুখ্যমন্ত্রীকে খুন করে তৃণমূলকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দেওয়ার জন্য গভীর ষড়যন্ত্র চলছে!”

মালদহের ঘটনাতেও মদনবাবু ‘সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র’-এর অভিযোগ করেছিলেন। মুখ্য নির্বাচন কমিশনার ভি এস সম্পতকে চিঠি লিখে সমস্ত ঘটনা বৃহস্পতিবার রাতেই জানান তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়।

এ দিন নলহাটি থেকে চপারে দুপুর আড়াইটে নাগাদ সিউড়ির চাঁদমারি ময়দানের সভাস্থলে পৌঁছন মমতা। তার ঘণ্টাখানেক আগে সভাস্থলে উপস্থিত তৃণমূল নেতৃত্ব এবং পুলিশ-কর্তাদের মধ্যে হঠাৎ আলোড়ন। শোনা যায়, সভাস্থল কিলোমিটার ছয়েক দূরে কালভার্টের কাছে মিলেছে বিস্ফোরক। সঙ্গে সঙ্গে ‘অ্যান্টি সাবোতাজ টিম’ এবং পুলিশ-কর্তারা সেখানে ছুটে যান। পুলিশ সূত্রের খবর, বোলপুর-সিউড়ি সড়ক ধরে গাড়িতে, ট্রাক্টরে, বাসে সিউড়ির সভাস্থলে দলে দলে আসছিলেন তৃণমূল কর্মী-সমর্থকেরা। তাঁদেরই কয়েক জন প্রথম দেখেন, কালভার্টের পাশে লম্বা তার পড়ে আছে। সেই তারের উৎস খোঁজ করতে গিয়ে দেখা যায়, কালভার্টের ঠিক নীচে রয়েছে প্লাস্টিকে মোড়া কিছু একটা। এক প্রান্ত জোড়া রয়েছে স্যুইচবক্স জাতীয় কিছুর সঙ্গে। খবর ছড়ায় দাবানলের মতো। প্লাস্টিকের মোড়ক খুলে ফেলেন অতি উৎসাহী কিছু তৃণমূল কর্মী। ‘অ্যান্টি সাবোতাজ টিম’-এর সদস্যেরাও সাধারণ পোশাকেই বিস্ফোরক উদ্ধার করে তা নিষ্ক্রিয় করা শুরু করেন।

হাল্কা মেজাজে। সিউড়ির জনসভায় রাইমা ও রিয়ার সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়ের তোলা ছবি।

বীরভূমের পুলিশ সুপার রশিদ মুনির খান বলেন, “প্লাস্টিকের ভিতরে ছিল দু’টি জিলেটিন স্টিক এবং দু’টি ডিটোনেটর। এ ছাড়া, মিলেছে লম্বা তার। স্যুইচবক্সের মধ্যে ছিল ব্যাটারি ও ব্যাটারি-চার্জার। এ সব দিয়ে বিস্ফোরণ ঘটানো সম্ভব।” রাজ্য পুলিশের কর্তারা জানাচ্ছেন, বিস্ফোরকটি আইইডি (ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোজিভ ডিভাইস) ধরনের। পুলিশের এক কর্তার কথায়, “শক্তিশালী বিস্ফোরণ ঘটানো এর সাহায্যে সম্ভব ছিল না। তবে, আতঙ্ক ছড়াতে যথেষ্ট। কারা এর সঙ্গে জড়িত, তা আমরা খতিয়ে দেখছি। মাওবাদী যোগাযোগের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে না।” পুলিশ সূত্রের খবর, এই ঘটনায় স্থানীয় চার জনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

সিপিএমের জেলা সম্পাদক দিলীপ গঙ্গোপাধ্যায় অবশ্য বলেন, “ওই এলাকায় তৃণমূল টানা সন্ত্রাস চালাচ্ছে। আমাদের কর্মী-সমর্থকেরা প্রায়ই আক্রান্ত হচ্ছেন। এ দিনও হয়েছেন।” বিস্ফোরক রাখার অভিযোগ প্রসঙ্গে দিলীপবাবুর দাবি, “তার নিয়ে খেলা করা আমাদের কাজ নয়। গোটাটাই তৃণমূলেরই সাজানো। মিথ্যা অভিযোগ তুলে আমাদের কর্মীকে ওরা মেরেছে।” একই সুরে সিপিএমের সিউড়ি জোনাল কমিটির সম্পাদক দেবাশিস গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “ঘটনাটা সাজানো না হলে তারটা কেন শুধু তৃণমূল কর্মীরাই দেখতে পেলেন? আসলে আমরাই ওখানে আক্রান্ত।” তাঁর সংযোজন, “ওই এলাকায় কয়েক দিন ধরে ভোট-প্রচারে আমরা সাড়া পাচ্ছি। তাতে আতঙ্কিত হয়েই তৃণমূল এই কাণ্ড করেছে।”

শুক্রবার গভীর রাত পর্যন্ত শেখ হীরালালের পরিবারের বা দলের তরফে কোনও লিখিত অভিযোগ করা হয়নি। দেবাশিসবাবুর বক্তব্য, “হীরালালের শেষকৃত্য মেটানো আমাদের প্রাথমিক কর্তব্য। তার পরে অবশ্যই অভিযোগ করব।”

জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল (যিনি এ দিনও সিউড়ির সভায় তৃণমূল নেত্রীর পাশে পাশেই ছিলেন) অবশ্য সিপিএমের অভিযোগ মানেননি। তাঁর দাবি, “এ রকম কোনও ঘটনাই ঘটেনি।” উল্টে অনুব্রতর অভিযোগ, “বিরোধীরা চক্রান্ত করে নাশকতা ঘটানোর চেষ্টা করেছিল, যাতে বোলপুর, নানুর, লাভপুর থেকে আমাদের কর্মী-সমর্থকেরা মুখ্যমন্ত্রীর সভায় যেতে না পারেন।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Explosives found on road which Mamata was to take
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE