সুদিন কবে ফিরবে? নেই নর্দমা। নোংরা জল তাই নেমেছে রাস্তায়।
কয়েকশো বছরের পুরনো ছোট্ট একটা জনপদ। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সেই জনপদের গায়ে এখন নগর-সভ্যতার ছোঁয়া লেগেছে। পঞ্চায়েত এলাকা হলেও ব্লক সদর পাত্রসায়রের নাগরিক জীবনেও পড়েছে শহুরে আদব কায়দার ছাপ। বাড়ছে এই জনপদের পরিধি, বাড়ছে বসতি। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জনসংখ্যাও। ততই বাড়ছে নাগরিক সমস্যা, চাহিদাও।
পাত্রসায়রের নামকরণের ইতিহাস আজও অজানা। তবে এই জনপদের নামের সঙ্গে জুড়ে রয়েছে ‘সায়ের’ নামে এলাকার এক বিশালাকার জলাশয়। পূর্ব দিকে বাবা কালঞ্জয়ের মন্দির, পশ্চিমে সায়ের নামক জলাশয়। হলুদবুনি মোড় থেকে বাইপাস মোড়, ব্লক অফিস, মুসলিমপাড়া থেকে হাজরাপাড়া, তার মাঝে দক্ষিণপাড়া, কামারপাড়া, বাজার, পোদ্দারপাড়া, দাসপাড়া, ধোবাপাড়া, হাটতলা, রাসতলা, বাউরিপাড়া, লোহারপাড়া, বাসস্ট্যান্ড এলাকা। এই নিয়ে এই জনপদ।
কালক্রমে মল্লরাজাদের রাজত্বে সেই জনপদের নামই হয় ‘পাত্রসায়র’। কী ভাবে এই নাম হল তার ইতিহাস নিয়ে অবশ্য নানা প্রচলিত মত রয়েছে। বাঁকুড়া জেলার বিশিষ্ট লোক সংস্কৃতি গবেষক তথা পাত্রসায়র বামিরা গুরুদাস বিদ্যায়তনের সহকারি প্রধান শিক্ষক রাজেন্দ্র প্রসাদ হাজরার মতে, “হাজরা পরিবারের আদিপুরুষ নন্দরাম হাজরা ছিলেন তদানীন্তন মল্লরাজের অত্যন্ত প্রিয়পাত্র। তিনি উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী ও সভাসদ ছিলেন। মল্লরাজের প্রিয়পাত্র হিসাবে নন্দরামবাবুর পদবি সম্বোধন হত ‘পাত্র’ রূপে। সেই সময় এলাকার জলকষ্ট দূর করার জন্য নন্দরামবাবু দাসপাড়া, মেটেপাড়া, হাটতলা ও মুসলিমপাড়ার মাঝে একটি বৃহৎ পুকুর বা সায়ের খনন করেছিলেন। নন্দরামের (পাত্র) ‘সায়ের’ হিসেবে এলাকার নামকরণ হয়ে যায় পাত্রসায়র।” স্থানীয় শিক্ষক ভগবতীচরণ দত্তের দাবি, “বহু বছর পূর্বে ওই সায়ের নামক জলাশয়ের পাড়ে পাত্র পদবিধারী বেশ কিছু পরিবার বসবাস করতেন। এলাকায় বড় বড় অসংখ্য পুকুর ছিল। বিশালাকার সেই পুকুরগুলিকে সাধারণ মানুষ সাগর বলে মনে করতেন। এলাকার মানুষ এই জনপদের নাম প্রথমে দেন ‘পাত্রসাগর’, পরে পাত্রসাগর নাম পরিবর্তিত হয়ে পাত্রসায়র হয়েছে।”
বাজারেও ছাউনি নেই।
২০১১ সালের আদমসুমারী অনুযায়ী এই পাত্রসায়রের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ১৮ হাজার। পরিবারের সংখ্যা প্রায় চার হাজার। ছোট বড় মিলিয়ে ৪০০-র বেশি দোকান রয়েছে। সরকারি একটি কলেজ, দু’টি হাইস্কুল, ৭টি প্রাথমিক স্কুল আছে। বেসরকারি আরও তিনটি নার্শারি স্কুল চলছে। উৎসব-পার্বণও কম নয়। বুদ্ধ পূর্ণিমার ৫ দিন আগে থেকে শুরু হয় গাজন উৎসব। এরপর রথযাত্রা, মনসা পুজো, শিবের মাথায় জল ঢালা, ঝুলন উৎসব থেকে মাঘী পূর্ণিমার মেলা... চলতেই থাকে। এলাকার বাসিন্দারা রসিকতা করে বলেন, ‘টাকার জোগান হয়ে গেলে ছোটখাটো পুজো নিয়েও পাত্রসায়রে কয়েকদিনের উৎসব শুরু হয়ে যায়।”
কিন্তু গত কয়েকবছর ধরে রাজনৈতিক টানাপড়েনে পাত্রসায়রের চেনা ছবিটা যেন কিছুটা বদলে গিয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের খেদ, গত পঞ্চায়েত ভোটের পর এলাকায় বেশ কিছু উন্নয়নের কাজ হচ্ছিল। পাড়ায় পাড়ায় পানীয় জলের ব্যবস্থা, ঢালাই রাস্তার কাজ হয়েছে। কিন্তু লোকসভা ভোটের পর শাসকদলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে অধিকাংশই থমকে গিয়েছে। প্রাচীন এই জনপদ ঘুরলেই নাগরিক পরিবেষা নিয়ে নানা অভিযোগ চাক্ষুষ করা যায়।
এলাকার মানুষদের ভোগাচ্ছে বেহাল নিকাশি ব্যবস্থা। শুধু কয়েকটি এলাকায় হাইড্রেন রয়েছে। বাকি এলাকায় নিকাশীর হাল কহতব্য নয়। কোথাও নিকাশি নালার জল নর্দমা উপছে রাস্তার উপর দিয়ে বইছে, কোথাও আবার নিকাশি নালা বুজে গিয়েছে আবর্জনার স্তূপে, আবার কোথাও নিকাশি নালাই নেই।
পাত্রসায়র বাজারে প্রতিদিন সব্জি ও মাছ নিয়ে বহু চাষি ও ব্যবসায়ী আসেন। কিন্তু শতাব্দী প্রাচীন এই সব্জি বাজারে হাতে গোনা কয়েকটি ছাউনি রয়েছে। অধিকাংশ ব্যবসায়ী খোলা আকাশের নীচে বিক্রিবাটা করেন। সব্জি ব্যবসায়ী বাপন লোহার বলেন, “ছাউনির অভাবে গ্রীষ্ম-বর্ষায় ক্রেতা-বিক্রেতা সবারই কষ্ঠ। নেই শৌচাগারও। আমাদের কষ্টের কথা কেউ ভাবে নাকি?” তাঁদের দাবি, অন্যন্য ব্লক সদরের মতো এখানেও আধুনিকমানের মার্কেট কমপ্লেক্স তৈরি করা হোক।
রাস্তার হাল নিয়েও কম ক্ষোভ নেই। পাত্রসায়র বাজার থেকে কীর্তন মেলা যাওয়ার রাস্তায় ধোবাপাড়া, গড়ধার এলাকায় রাস্তা রীতিমতো বিপজ্জনক। শুখা দিনেও রাস্তা জল-কাদায় ভরে থাকে। বাসিন্দাদের ক্ষোভ, একফালি সরু নর্দমা জল ও আবর্জনায় ভরে থাকে। তাই মাঝেমধেই সেই জলে রাস্তা ভেসে যাচ্ছে। বাধ্য হয়ে সেই নোংরা জলের উপর দিয়েই যাতায়াত করতে হচ্ছে পথচারীদের। পাত্রসায়রের বাজার থেকে রাসতলা, সিং পাড়ার ভিতর দিয়ে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত রাস্তাটি সম্প্রতি ঢালাই করা হয়েছে। কিন্তু দাসপাড়া থেকে মুসলিমপাড়া হয়ে গড়ধার, শাহাজীতলা থেকে মুসলিমপাড়া, দক্ষিণপাড়া থেকে কামারপাড়া, দাসপাড়া থেকে ধোবাপাড়া হয়ে নেতাজী স্ট্যাচু পর্যন্ত রাস্তাগুলির অবস্থা তথৈবচ। বাসিন্দারা ওই রাস্তাগুলিও ঢালাই করার দাবি জানিয়েছেন। বাসস্ট্যান্ড থেকে হলুদবুনি মোড় পর্যন্ত পাকা রাস্তাটি ক্রমশ সঙ্কীণ হয়ে পড়েছে। কোনরকমে একটা বড় গাড়ি চলাচল করতে পারলেও দু’টি বড় গাড়ি মুখোমুখি হলেই পাশ কাটানোর জায়গা থাকে না। পাত্রসায়র বাজার ব্যবসায়ী সমিতির প্রাক্তন সভাপতি জলদবরণ দে বলেন, “বাঁকুড়া-বর্ধমান রুটের বহু বাস পাত্রসায়র বাসস্ট্যান্ডে ঢুকছে না। বাজারে যাত্রী প্রতীক্ষালয়, শৌচাগার কিছুই নেই। তাই সব বাসকে পাত্রসায়রে ঢোকানো, বাজারে মার্কেট কমপ্লেক্স তৈরির দাবি জানিয়েছি আমরা।”
পাত্রসায়র গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান তৃণমূলের সুব্রত কর্মকার বলেন, “পরিকল্পনা থাকলেও অর্থের অভাবে অনেক কাজ করা যাচ্ছে না। তবে অনেক রাস্তা সংস্কার করা হয়েছে। কয়েকটি রাস্তা ঢালাইও করা হয়েছে।” তাঁর মতে, নর্দমায় আবর্জনা না ফেললেই নিকাশির সমস্যা অনেকটা মিটে যাবে। পাত্রসায়রের বিডিও অপূর্বকুমার বিশ্বাস বলেন, “পঞ্চায়েত সমিতি মার্কেট কমপ্লেক্স, মিনি সাব মার্সিবল পাম্প ও শৌচাগার তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছে। এ জন্য ৪৪ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। ৩০টি ডাস্টবিন তৈরি করা হবে। শীঘ্রই তার টেন্ডার ডাকা হচ্ছে।”
ছবি: শুভ্র মিত্র
কেমন লাগছে আমার শহর?
নিজের শহর নিয়ে আরও কিছু বলার থাকলে আমাদের জানান।
ই-মেল পাঠান district@abp.in-এ
subject-এ লিখুন ‘আমার শহর পুরুলিয়া-বাঁকুড়া।
ফেসবুকে প্রতিক্রিয়া জানান: www.facebook.com/anandabazar.abp।
অথবা চিঠি পাঠান ‘আমার শহর’, পুরুলিয়া-বাঁকুড়া বিভাগ, জেলা দফতর
আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০০০১ ঠিকানায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy