লক্ষ্য ছিল, ১৫ থেকে ৬০ বছর বয়সী নিরক্ষরদের (মূলত মহিলা) সাক্ষর করে তোলা। সেই লক্ষ্যে দেশের অন্য রাজ্যের সঙ্গে এ রাজ্যের বীরভূম জেলাতেও চালু হয়েছিল ‘সাক্ষর ভারত মিশন’। কিন্তু কাগজে কলমে প্রকল্পের সাফল্যের খতিয়ান মিললেও, বাস্তব চিত্র অন্য কথা বলছে। পরিস্থিতি এমনই হতাশার যে, প্রকাশ্যে না বললেও সে কথা আড়ালে মেনে নিচ্ছেন বীরভূম জেলা প্রশাসনের শীর্ষ কর্তারা।
২০০৯ সালে ‘সাক্ষর ভারত মিশন’ নামে কেন্দ্রীয় প্রকল্পটি চালু হয়। জেলা প্রশাসনের তথ্য বলছে, জেলায় ৩লক্ষ ৮০ হাজার ৬২৬ জন চিহ্নিত নিরক্ষর মানুষের মধ্যে ইতিমধ্যেই ২লক্ষ ৬৩ হাজার ২৯৩ জনকে স্বাক্ষর করে তোলা সম্ভব হয়েছে। প্রশ্ন সেখানেই, কাগজে কলমে সাফল্যের যে ছবি, তার সঙ্গে বাস্তব চিত্রের কোনও মিলই নেই!
কেন নেই?
‘সাক্ষর ভারত মিশন’-এর কর্মীদেরই দেওয়া তথ্যে জানা যায়, কাগজে কলমে জেলায় ২৩, ৩২৮টি সাক্ষরতা কেন্দ্র চালু থাকার কথা বলা থাকলেও বাস্তবে অধিকাংশেরই কোনও অস্তিত্ব নেই। যেগুলির ছিল, এখন আর চালুও নেই সেগুলি। দ্বিতীয়ত, কাগজে কলমে যাঁরা স্বাক্ষর বলে দাবি করছেন প্রশাসন বা নির্দিষ্ট সাইটে যাঁদের স্বাক্ষর বলে উল্লেখ করা হয়েছে, তাঁদের সিংহভাগকেই সেই টিপ সইয়ের উপর ভরসা করে আছেন এখনও। আর যাঁরা নিজের সই আঁকতে শিখেছেন, তাঁদের অনেকেই দু’ছত্র পড়তেও পারেন না!
প্রকল্পের সাফল্যের খতিয়ানে জেলার যে সমস্ত গ্রামের কথা রয়েছে, দুবরাজপুরের মেটেলা তেমন একটি গ্রাম। এ গ্রামের একটি মহিলা স্বনির্ভর দলের দলনেত্রী চিত্রা বাউড়ির সঙ্গে কথা বলে আন্দাজ হয় সমস্যার স্বরূপ। বেশ কয়েক বছর ধরে স্বনির্ভর দল চালানোর পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবী শিক্ষিকা হিসাবে নিজের বাড়িতেই দলেরই দশ জন নিরক্ষর সদস্যকে নিয়ে সাক্ষরতা কেন্দ্র চালান তিনি। পাঁচ জনকে সই আঁকতে শেখাতে পারলেও বাকি পাঁচজন এখনও টিপ সই করে থাকেন বলে জানিয়েছেন তিনি। প্রায় একই অভিজ্ঞতা অন্য স্বনির্ভর দলনেত্রী তথা ভিটি সুলেখা মাল, আল্পনা দাসদেরও। চিত্রা তবু নিজের কাজ করে চলেছেন। যে কেন্দ্রগুলি বন্ধ, সেখানে শিখতে আসা নিরক্ষরদের অবস্থা কেমন?
দুবরাজপুরের গোহালিয়াড়া পঞ্চায়েতের একসময়ের ৩০টি স্বাক্ষরতা কেন্দ্রের মধ্যে বর্তমানে চালু মাত্র ১০টি কেন্দ্র। খয়রাশোলের পাঁচড়া পঞ্চায়েতের ৪৯টি স্বাক্ষরতা কেন্দ্রের মধ্যে বন্ধ ২৩টি। এই চিত্র শুধু দুবরাজপুর, খয়রাশোলের নয় প্রায় গোটা জেলারই। জেলাজুড়েই মিলছে ‘সাক্ষর ভারত মিশন’-এর এমন বেহাল চিত্রের খতিয়ান।
এমনটা হওয়ার কারণ কী?
প্রকল্পে যুক্ত চুক্তি ভিত্তিক ২৫৭৯১ জন কর্মীর একাংশের অভিযোগ, “ভাতা সময়মত এবং নিয়মিত না পাওয়া, বা অত্যন্ত কম পাওয়া, প্রয়োজনীয় পরিকাঠামোর সমস্যা রয়েছে। পঠনপাঠনের উপযোগী উপকরণের অভাব এবং সর্বপরি একাজে যুক্তদের সকলের প্রশিক্ষণও নেই।” জানা গেল, মাত্র ৯৭৪৩ জনের প্রশিক্ষণ রয়েছে। প্রকল্প রূপায়নে প্রধান দায়িত্বও তাঁদের ওপর। নিয়মিত ভাতা বা সম্মানিক না পাওয়াও একটি কারণ উৎসাহ হারানোর জন্য। এবং তাঁদের উৎসাহে ঘাটতির কারণেই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্যই এখন প্রশ্ন চিহ্নের মুখে।
২০০৯ সালের ৮ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসের দিনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ‘সাক্ষর ভারত মিশন’ নামে ওই প্রকল্পের কথা ঘোষনা করেছিলেন। জাতীয় মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের আওতাধীন সাক্ষরতা মিশনে দেশের ৭কোটি নিরক্ষর মানুষকে সাক্ষর করার লক্ষ্য মাত্রা নেওয়া হয়েছিল। ঠিক হয়, কেন্দ্রীয় সরকারের ৭৫ শতাংশ ও রাজ্য সরকারের ২৫ শতাংশ অর্থ সাহায্যে চলা ওই প্রকল্পকে বাস্তবায়িত করতে বেশ কয়কটি ধাপ তৈরি করা হবে। চুক্তির ভিত্তিতে কর্মী নিয়োগও চূড়ান্ত হয় সেই তখনই। প্রতি জেলায় ৪জন কো-অর্ডিনেটর বা সমন্বায়ক, প্রতি ব্লকে একজন করে কো-অর্ডিনেটর বা সমন্বায়ক এবং প্রতিটি ব্লক সমন্বায়কের নীচের ধাপে পঞ্চায়েতে দু’জন করে থাকবেন প্রেরকেরা।
প্রকল্প শুরু করার পর জেলা ও ব্লক কো-অর্ডিনেটর, পঞ্চায়েত ভিত্তিক প্রেরকদের এবং ভিটিদের নিয়োগ করা হয় মাসিক চুক্তিতে। সমস্যার সূত্রপাত প্রধানত এখান থেকেই।
প্রথম প্রথম স্বেচ্ছা শ্রমদানকারী শিক্ষক বা ভিটি-রা বছরের পর বছর এভাবে বিনা সাম্মানিকে ‘সাক্ষর ভারত মিশন’ প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত থাকার ইচ্ছেটাই হারিয়েছেন। এছাড়া, পড়ুয়াদের পঠন পাঠনের জন্য নির্দিষ্ট উপকরণ বলতে বই, চক আর ব্লাকবোর্ড ছাড়া কিছুই নেই। সাক্ষরতা কেন্দ্র গুলি হয় ভিটিদের বাড়িতে বা কারও বাড়ির দাওয়ায় বা স্থানীয় ক্লাব ঘরে চলে। সাক্ষর হতে আসা মহিলাদের বসার জায়গা ও কেরোসিনের খরচ ভিটিদেরই যোগাতে হয়। তাঁদের প্রশ্ন, “কিসের জন্য দিনের পর দিন ঘরের খেয়ে এভাবে কাজ চালানো সম্ভব?”
অন্য দিকে, প্রেরকদের জন্য বরাদ্দ ২ হাজার টাকাও তাঁরা নিয়মিত পান না বলে জানিয়েছেন জেলার বিভিন্ন প্রান্তের প্রেরকেরা। কোনও কোনও সময়, সেই টাকা ৭-৮ মাস এমনকী একবছর বাকি থাকার পর এককালীন হাতে পান। এতে ক্রমশই কাজে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন প্রেরকরা। কেউ কেউ ভরসা হারিয়ে বিকল্প রুজির খোঁজে কাজ ছাড়ছেন। একই অবস্থা ব্লক কো-অর্ডিনেটরদেরও। ভাতার টাকা নিয়মিত পান না তাঁরাও। কিন্তু ব্লকে থাকতে হয় বলে, নিজেদের কাজের বাইরে বিডিও-র নির্দেশে ব্লকের অন্যান্য কাজে যুক্ত থাকতে বাধ্য হন তাঁরাও। যে কাজের জন্য তাঁরা নিযুক্ত হয়েছিলেন, এতে বাদ পড়ে যায় সেই আসল কাজই। প্রশ্ন উঠছে, তাহলে সাক্ষরতা অভিযান চলছে কী ভাবে?
কাগজে কলমে নিরক্ষরদের সাক্ষর করার হার কিন্তু বেড়েই চলেছে। জেলা প্রশাসনের একটি মহল জানাচ্ছে, প্রতি বছর নিয়ম করে রাজ্য, জেলা, ব্লক ও পঞ্চায়েত স্তরে বেঁধে দেওয়া লক্ষ্য মাত্রা পূরণ হয়ে যাচ্ছে ‘জল’ মিশিয়েই। চুক্তিভিত্তিক সরকারি প্রকল্পে যুক্ত হয়ে প্রকাশ্যে অবশ্য কেউই মুখ খুলতে চাননি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা, ব্লক কো-অর্ডিনেটর বা প্রেরক-ভিটিরা সকলেই বলছেন, “অধিকাংশ পঞ্চায়েতে লোকশিক্ষার কেন্দ্র থাকলেও পড়ুয়ার অভাব রয়েছে। গ্রাম বা পাড়ায় যে যে সাক্ষরতা কেন্দ্রগুলি থাকার কথা তার অর্ধেকেরই কোনও অস্বিত্ব নেই। অগত্যা জল মেশানো ছাড়া তখন উপায় কী!”
যাঁদের উপর প্রকল্প রূপায়নের মূল দায়, পরিকাঠামো ছাড়া, টাকাপয়সা ছাড়া তাঁরাই বা কেন এভাবে বছরের পর বছর কাজ করে যাবেন? এ প্রশ্ন তুলে, তাঁদের দাবি, “নিরক্ষর পড়ুয়াদের খুঁজে বের করা থেকে তাঁদের মূল্যায়ন সবেতেই বস্তব আর তথ্যের ফারাক বিস্তর ফারাক।”
প্রশাসন সূত্রের খবর, নিয়ম অনুযায়ী দু’বার, অগষ্ট ও মার্চ মাসে পড়ুয়াদের মূল্যায়ন হয়। তখন নিরক্ষর পড়ুয়া যাঁদেরকে সাক্ষরতার আওতায় নিয়ে আসার কথা, তাঁদের বদলে স্থানীয় প্রাথমিক স্কুল, এসএসকে বা এমএসকে থেকে বৈধ পড়ুয়াদের ডেকে এনে কোনও ক্রমে সেই মূল্যায়ন উতরে দেওয়া হয়! জেলা লোকশিক্ষা সমিতির ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক সম্রাট মণ্ডলের দাবি, “শুনতে যতটা খারাপ, বাস্তবে ঠিক ততটা নয়। প্রকল্পে সাক্ষরতার হার এ জেলায় ভাল।” পঠন পাঠনের উপকরণের সমস্যার কথাও তিনি মানতে চাননি। তাঁর কথায়, “প্রাপকদের ভাতা আসা নিয়ে সমস্যা থাকলেও ফান্ড এলেই তা মিটিয়ে দেওয়া হয়।”
প্রশাসনের যুক্তি, অনলাইন এন্ট্রি করে তার রিপোর্ট পাঠালে তবেই পরের বরাদ্দ আসে। কি বলছে জেলা প্রশাসন? অতিরিক্ত জেলা শাসক বিধান রায় বলেন, “কিছু সমস্যা রয়েছে। নজরে রয়েছে ভিটিদের ১০০ দলের মত কেন্দ্রীয় প্রকল্পে কাজে লাগাতে। বিডিও দের নির্দেশ দিয়েছি। যাতে ওঁরা আয়ের সুযোগ পান, হতাশ না হয়ে পড়েন।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy