পুষ্প পণ্ডা।—নিজস্ব চিত্র।
স্বামী মারা গিয়েছেন ৫১ বছর আগে। স্বামীর স্কুল, জেলা পরিদর্শকের অফিস, কলকাতার পেনশন বিভাগ বিভিন্ন দফতর ঘুরতে ঘুরতে শেষে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন এক বৃদ্ধা। হাইর্কোটের নির্দেশে ৭১ বছরে পৌঁছনো সেই বৃদ্ধার হাতে এল পেনশনের অর্ডার। পেনশন বিভাগ ৪ অগস্ট পুষ্প পণ্ডাকে পারিবারিক পেনশন দেওয়ার ছাড়পত্র দিয়েছে।
পেনশনের আদায়ের জন্য শুধু সরকারি কর্মীর বিধবা স্ত্রী নয়, অবসরপ্রাপ্তদেরও অনেক সময় কম হয়রান হতে হয় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আদালতের দ্বারস্থ হয়েই তাঁরা প্রাপ্য আদায় করেছেন। তবুও সেই সব ভিড়ের মধ্যে পুরুলিয়ার পুঞ্চা থানার ছিরুডি গ্রামের অশ্বিনী পণ্ডা-র স্ত্রী পুষ্পদেবীর লড়াই নজরকাড়া। দুই শিশু সন্তানকে আঁকড়ে ধরে দীর্ঘ লড়াই চালিয়ে তিনি নিজের প্রাপ্য আদায় করেছেন।
পুরুলিয়া লাগোয়া বাঁকুড়া জেলার ইঁদপুর থানার শালডিহা হাইস্কুলের শিক্ষক ছিলেন অশ্বিনীবাবু। ২ বছর ৩ মাস শিক্ষকতা করার পরে ১৯৬৩ সালের ১৯ ডিসেম্বর রোগে ভুগে তাঁর মৃত্যু হয়। তখন ছ’মাস ও দেড় বছরের দু’টি ছেলেকে নিয়ে কার্যত দিশেহারা অবস্থা পুষ্পদেবীর। সামান্য জমিই ভরসা। তিনি জানান, কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। স্বামীর কয়েকজন সহকর্মী জানিয়েছিলেন, বিধবা স্ত্রী হিসেবে স্কুলে তিনি চাকরি পেতে পারেন। স্কুলে ছুটে গিয়েছেন। বাঁকুড়ায় জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শকের অফিসেও গিয়েছেন। লাভ হয়নি। স্বামীর চাকরি সংক্রান্ত বিভিন্ন কাগজপত্র চাওয়া হয়। সংসার সামলে সে সব জোগাড় করতে বিভিন্ন জায়গাও যাতায়াত করেও বিশেষ সুবিধা হয়নি।
তাঁর কথায়, “টানাটানির সংসারে দু’টি ছোট ছেলেকে বড় করতে হিমশিম খেতে হয়েছে। তারই মধ্যে একবার বাঁকুড়া, একবাঁর ইঁদপুরের স্কুলে যাতায়াত করতে করতে নাকাল হয়ে গিয়েছি। আশাও ছেড়ে দিয়েছিলাম। ছেলেগুলোকে পড়াশোনা করিয়ে বড় করতে খুব কষ্ট করতে হয়েছে।” চাকরির আশা যখন ছেড়ে দিয়েছেন, আশির দশকে ফের তাঁর স্বামীর সহকর্মীরা খবর দিলেন, পারিবারিক পেনশনের জন্য তিনি আবেদন করতে পারেন। ফের নিজের প্রাপ্য আদায়ে দৌড়ঝাঁপ শুরু পুষ্পদেবীর।
তখন তাঁর দুই ছেলেই স্কুলের ছাত্র। আর্থিক অবস্থাও ভাল নয়। কখনও পড়শিদের সঙ্গে নিয়ে, কখনও বা একাই স্বামীর স্কুল ও জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শকের অফিসে যাতায়াত শুরু করেন। কিন্তু পেনশন চালু করার জন্য প্রয়োজনীয় নথি জোগাড় করে উঠতে পারছিলেন না। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে শেষে নথি যখন জোগাড় করে আবেদন জানালেন, তখন পেনশনও চালু হল না। এ জন্য কলকাতায় পেনশন বিভাগেও তাঁকে কমবার যেতে হয়নি। শেষে ২০১৩ সালে কলকাতায় হাইকোর্টে পেনশন চেয়ে মামলা করেন তিনি। তাঁর কথায়, “সরকারি অফিসে অফিসে এতদিন ঘুরেও যা পাইনি, হাইকোর্ট আমাকে সেই প্রাপ্য ফিরিয়ে দিল।”
পুষ্পদেবীর বড়ছেলে পুরুলিয়ার মানবাজার ২ ব্লকের কৃষি প্রযুক্তি সহায়ক অপূর্ব পাণ্ডা বলেন, “বাঁকুড়ার ট্রেজারি অফিসে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জেনেছি, শুধু পেনশনই নয়, এতদিনের বকেয়া ‘এরিয়ার’-র টাকাও পাওয়া যাবে।’’ তিনি জানান, পেনশনের নির্দেশ পাওয়ার পরেই তাঁরা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলে প্রয়োজনীয় কাজ সেরে নিয়েছেন। এত খুশির মধ্যেও অপূর্ববাবু বলেন, “মায়ের লড়াইকে কুর্নিশ করতেই হবে। ভয়ানক দারিদ্রের মধ্যে আমাদের দিন কেটেছিল। কলেজ পাশ করার পরে কৃষি দফতরে চাকরি পাওয়ার পরে কিছুটা সুখের মুখ মাকে দেখাতে পেরেছিলাম।”
এত সময় লাগল কেন? অপূর্ববাবু জানান, তাঁর বাবার চাকরি সংক্রান্ত কাগজপত্র ঠিক ছিল না। নিয়োগপত্র, ‘সার্ভিস বুক’ জোগাড় করতে তাঁদের বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। কিন্তু সে সব জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শকের অফিসে জমা দিয়েও কাজ হচ্ছিল না দেখে হাইকোর্টে আবেদন জানানো হয়। পুষ্পদেবীর আইনজীবী মহাদেব খান বলেন, “এত অল্প সময়ের চাকরির মেয়াদের জন্য উনি পেনশন পাবেন কি না, তা নিয়ে বিতর্ক ছিল। এর থেকেও কম মেয়াদের চাকরি করে পেনশন পাওয়ার নজির আদালতে পেশ করার পরে হাইকোর্ট ওই নির্দেশ দিয়েছে।”
ইঁদপুরের শালডিহা হাইস্কুলের প্রধানশিক্ষক তারাপদ পতি বলেন, “পুরনো নথি ঘেঁটে আমরা অপূর্ববাবুকে তাঁর বাবার চাকরি সংক্রান্ত কাগজপ্ত দিয়েছিলাম। শুনেছি, তাঁর মা-কে পেনশন দেওয়ার নির্দেশ এসেছে।” বাঁকুড়ার জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শক (মাধ্যমিক ) অমিয়বরণ গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “পুষ্পদেবীর পেনশন পাওয়ার নির্দেশ এসেছে শুনেছি। সম্ভবত ওই স্কুলে কোনও গোলমালের জেরে উনি নথি পাচ্ছিলেন না।”
এত খুশির মধ্যেও চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে বৃদ্ধার। আক্ষেপ করে বলেন, “পেনশনের টাকা কম হলেও ওই দুর্দিনে পেলে এর মূল্য আমাদের কাছে অনেক হত।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy