Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

ভাষার জন্য লড়াইয়ে জেলার জন্ম

এ দিন ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের কথা পড়ুয়ারা মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনেছে। তাদের মধ্যে সুচেতা রায়, অনিন্দিতা বাউরি, মৌমিতা বাউরি জানায়, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের কথা জানি। কিন্তু আমাদের জেলাতেই যে এ ধরনের একটি ইতিহাস রয়েছে, আগে জানা ছিল না।’’

(বাঁ দিক থেকে) নকুল মাহাতো ও নিরঞ্জন মাহাতো। নিজস্ব চিত্র

(বাঁ দিক থেকে) নকুল মাহাতো ও নিরঞ্জন মাহাতো। নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
মানবাজার শেষ আপডেট: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০০:১৪
Share: Save:

উর্দু নয়, বাংলা চাই, এই দাবিতে আন্দোলন হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানে(বর্তমানে বাংলাদেশ)। আর এ পার বাংলায় বাংলা ভাষার দাবিতে আন্দোলন হয়েছিল মানভূম জেলায়। যা থেকে বিহার ভেঙে তৈরি হয়েছিল একটা জেলা— পুরুলিয়া।

বুধবার ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের সকালে পুরুলিয়া জেলার জন্মের সেই ইতিহাস শুনল পড়ুয়ারা। মানবাজারের স্বপন সুব্রত হাইস্কুলে ভাষা দিবসের স্মরণে আয়োজিত আলোচনাসভায় উঠে এল জেলার ভাষা আন্দোলনের কথা।

এ দিন সকালে এলাকার ছাত্রছাত্রী, প্রশাসনিক আধিকারিক ও সাধারন বাসিন্দাদের নিয়ে বিরাল র‌্যালি বেরোয় মানবাজারে। প্রায় হাজার দুয়েক মানুষ পা মিলিয়েছিলেন। তারপর স্কুলে দু’টি ধাপে হয় আলোচনাসভা। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে মাতৃভাষার অধিকার এবং পুরুলিয়া তথা সাবেক মানভূম জেলার ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে বিশিষ্টজনেরা বক্তব্য রাখেন।

অধ্যাপক প্রদীপ মণ্ডল ও তপন পাত্র তাঁদের বক্তব্যে তুলে ধরেন, সাবেক মানভূম জেলায় কোন পরিস্থিতিতে ভাষা আন্দোলনের জন্ম হয়েছিল। স্বাধীনতা লাভের পরে বাংলাভাষী মানভূম জেলা বিহারে থেকে গিয়েছিল। ১৯৩১ সালের জনগণনা অনুসারে সেই সময় মানভূম জেলার শতকরা ৮৭ জন বাংলাভাষী ছিলেন। মানভূমবাসীর দাবি ছিল, বাংলা যেহেতু তাঁদের মাতৃভাষা, সে কারণে মানভূম জেলাকে পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। স্বাধীনতা লাভের পরে প্রায় ন’বছর আন্দোলন চালানোর পরে মানভূম জেলার খণ্ডিত অংশ পুরুলিয়া জেলা নামে পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।

আলোচকেরা জানান, ভাষা আন্দোলনের এই ইতিহাস বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই খবর রাখেন না। আন্দোলনের চরম ধাপে পুঞ্চার পাকবিড়রা গ্রাম থেকে এক হাজার পদযাত্রী মানভূম জেলাকে পশ্চিমবঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করার দাবিতে কলকাতা পর্যন্ত হেঁটে গিয়েছিলেন। আন্দোলনের চাপে ১৯৫৬ সালের ১ নভেম্বর পুরুলিয়া জেলা পশ্চিমবঙ্গে অন্তর্ভুক্ত হয়। অধ্যাপক প্রদীপ মণ্ডল বলেন, ‘‘স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে এই ইতিহাস থাকলেও, স্কুল পড়ুয়াদের পাঠ্যসূচিতে এই ইতিহাস ঠাঁই পায়নি।’’

এ দিনের সভায় উপস্থিত ছিলেন ভাষা আন্দোলনের দুই সেনানী। মানবাজার থানার বিসরি গ্রামের নিরঞ্জন মাহাতো এবং বোরো থানার রাঙামেটা গ্রামের নকুলচন্দ্র মাহাতো। নকুলবাবু বলেন, ‘‘১৯৫৬ সালের এপ্রিল মাসে ১৭ দিন পদযাত্রা করে আমরা কলকাতায় পৌঁছেছিলাম। পুলিশ আমাদের গ্রেফতার করেছিল। পরে ব্যক্তিগত বন্ডে সকলের জামিন হয়।’’ নিরঞ্জনবাবু বলেন, ‘‘৬২ বছর আগে মানভূম জেলা ভেঙে পুরুলিয়া জেলা গঠিত হয়েছিল। তবু মনে হচ্ছে যেন সে দিনের কথা।’’

মানভূম কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আশুতোষ বিশ্বাস ও আয়োজক স্কুলের প্রধান শিক্ষক পার্থসারথী মণ্ডলের মতে, ‘‘পুরুলিয়া জেলা যে এরকম একটি গৌরবজনক ইতিহাসের উত্তরাধিকার বহণ করে চলেছে, অনেকেই এ কথা জানেন না। বিভিন্ন সভায় আলোচনার মাধ্যমে এ কথা ছড়ানো উচিত।’’

এ দিন ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের কথা পড়ুয়ারা মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনেছে। তাদের মধ্যে সুচেতা রায়, অনিন্দিতা বাউরি, মৌমিতা বাউরি জানায়, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের কথা জানি। কিন্তু আমাদের জেলাতেই যে এ ধরনের একটি ইতিহাস রয়েছে, আগে জানা ছিল না।’’

মাতৃভাষার অধিকারকে বিস্তৃতির লক্ষ্যে এ দিন বাংলাভাষার পাশাপাশি সাঁওতালি ভাষাতেও নিজ ভাষার অধিকার বিষয়ক আলোচনা হয়েছে। বান্দোয়ানের বাসিন্দা সাহিত্যিক কলেন্দ্রনাথ মান্ডি সাঁওতালিতে বলেন, ‘‘প্রত্যেক ব্যক্তির নিজের ভাষায় কথা বলার, ভাব বিনিময় করার অধিকার রয়েছে। ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটি সব ভাষাভাষীদের জন্য একটি পবিত্র দিন।’’ মানবাজার মহকুমার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট তারকনাথ দাসের প্রতিক্রিয়া, ‘‘ভাষা দিবসকে সম্মান জানাতে এত মানুষ পথে নেমেছেন ভাবা যায় না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Language Movement Purulia
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE