Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

ফেরি করে মেয়ের বিয়ে সান্ত্বনার

তিলপাড়া সানাইতলা গণেশ কলোনির বাসিন্দা সান্ত্বনাদেবী শোনান তাঁর জীবন-সংগ্রামের খুঁটিনাটি। তিন বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন মেজ। ছিল এক দাদাও। বিয়ে হয় সিউড়ির হাটজনবাজারে।

প্রত্যয়ী: সান্ত্বনা রায়। নিজস্ব চিত্র

প্রত্যয়ী: সান্ত্বনা রায়। নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
সিউড়ি শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০১৮ ০১:৩৭
Share: Save:

২৩ বছরের হার না মানা লড়াইয়ে জীবন বদলের কাহিনি।

কোলে কয়েক দিনের শিশু। কিন্তু পাশে নেই স্বামী। আত্মীয়-বন্ধুও। চরম দারিদ্র ঘিরেছিল তাঁকে।

২৩ বছর আগের সে দিনের কথা ভোলেননি সান্ত্বনা রায়। এখন তিনি চল্লিশে। লেখাপড়া শিখিয়ে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন কলকাতায়। জামাই সুপ্রতিষ্ঠিত।

অতীতের কথা নিজেই জানান সান্ত্বনাদেবী। বাবা-মা মারা গিয়েছিল ছোটবেলায়। অর্থসঙ্কটে অষ্টম শ্রেণির পরে পড়তে পারেননি। বিয়ে হয় এমন এক জনের সঙ্গে, যাঁর অত্যাচারে সন্তানের জন্মের আগে বাধ্য হয়ে শ্বশুরবাড়ি ছাড়েন তিনি। চরম দারিদ্র ঘেরে চারপাশ। তখনই জন্ম হয় শিশুকন্যার। সাহায্যের আশায় দরজায় দরজায় ঘুরেছেন। সমবেদনাটুকুও মেলেনি কোথাও কোথাও।

সেই সময়ই পাশে পান সিউড়ির একটি হোমের বাসন্তী দাস, গোপা দাস, সমাজকর্মী ফরিদা ইয়াসমিনকে। তাঁরা তিন জনই এখন বলছেন— ‘‘হোম সাহায্য করেছে ঠিকই, কিন্তু ওঁর হার না মানা জেদ, পরিশ্রমে ভর করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা না থাকলে এখানে হয়তো পৌঁছতে পারতেন না।’’

তিলপাড়া সানাইতলা গণেশ কলোনির বাসিন্দা সান্ত্বনাদেবী শোনান তাঁর জীবন-সংগ্রামের খুঁটিনাটি। তিন বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন মেজ। ছিল এক দাদাও। বিয়ে হয় সিউড়ির হাটজনবাজারে। তার পরই শুরু হয় অত্যাচার। সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়েন তিনি। কিন্তু স্বামীর নির্যাতনে বাধ্য হয়ে সন্তানের জন্মের আগেই শ্বশুরবাড়ি ছাড়েন। তত দিনে বোনেদের বিয়ে হয়েছে। দাদার সামান্য আয়। তাঁর সংসারে থাকা তা-ই সম্ভব ছিল না। একরত্তি মেয়েকে নিয়ে কী ভাবে বাঁচবেন সেই চিন্তায় দিন কাটছিল সান্ত্বনাদেবীর।

গ্রাম পঞ্চায়েতের মাধ্যমে ওই সময়ই সিউড়ির হোমে ঠাঁই মেলে তাঁর। কয়েক বছর সেখানে থাকেন মা, মেয়ে। মেয়ে রুমার পড়াশোনা শুরু হয় হোমেই। মাথার উপর ছাদ পেয়েও মাথা উঁচু করে বাঁচতে পাড়ায় পাড়ায় মনোহারি, প্রসাধনী জিনিসের ফেরি করতে থাকেন সান্ত্বনাদেবী। কাজ জোটে একটি বেসরকারি স্কুলে। একটু টাকা জোগাড় হতেই মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ভাড়া করে তিনি চলে যান তিলপাড়ায়। রাস্তায় পাশে অস্থায়ী ছাউনিতে দোকান খোলেন। একটি স্বনির্ভর গোষ্ঠীতেও সামিল হন। তিল তিল করে পয়সা জমিয়ে কিনে ফেলেন একটি জমি। মেয়েকে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক পড়ানোর পর কলেজে ভর্তি করান। তার মধ্যেই একটি পার্কে নিরাপত্তাকর্মীর কাজ পান। দোকানের ব্যবসাও চলে সমানতালে। কলেজে পড়তে পড়তেই মেয়ের বিয়ে দেন সান্ত্বনাদেবী।

এখন তিনি বলছেন, ‘‘অন্য কেউ আমরা মতো পরিস্থিতিতে পড়লে হয়তো আত্মহত্যার পথ বেছে নিত। কিন্তু আমি ঠিক করেছিলাম, যা-ই হয়ে যাক, কিছুতেই মরবো না। বাবাকে ছাড়াই মেয়েকে মানুষ করবো, বিয়ে দেব। যেটুকু আয় করি তাতেই আমার চলে যাচ্ছে। ধার যা রয়েছে, জমি বিক্রি করলে সেটা মিটে যাবে। আর কী চাই।’’

খুব কাছ থেকে যাঁরা সান্ত্বনাদেবীকে দেখেছেন, তাঁরা সকলেই বলেন— ‘‘মনের জোর রয়েছে বটে মহিলার। তাতেই বদলেছেন নিজের জীবন।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

mother Daughter Life Struggle Women's Day Special
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE