Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

আঠেরোয় রূপশ্রী নয়, পড়তে চায় চৌপাহাড়ির মেয়েরা

ওই প্রকল্পের নাম দেওয়া হয়েছে ‘রূপশ্রী’। প্রশাসনিক সূত্রে জানা গিয়েছে, ওই প্রকল্পের জন্য ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। প্রায় ৬ লক্ষ পরিবার এই প্রকল্পের সুবিধা পাবে।

নিজস্ব সংবাদদাতা
ইলামবাজার শেষ আপডেট: ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০০:৩৪
Share: Save:

রূপশ্রী প্রকল্পের কথা শুনেছে সকলেই। বয়সও ১৮ পেরিয়েছে। কিন্তু এখনওই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে নারাজ তাঁরা। আরও পড়তে চান, দাঁড়াতে চান নিজের পায়ে। গড়তে চান পরিচয়।

ইলামবাজার চৌপাহাড়ি জঙ্গল লাগোয়া মুরগাবুনি, ধল্লা, পুরানঢিল, বনসুলি, ঊষারডিহির মতো ১৪টি গ্রাম রয়েছে। গ্রামের বাসিন্দা সমীর মূর্মু, মহাদেব হাঁসদা, লক্ষীরানি হেমব্রমরা মূলত কৃষিজীবী বা দিনমজুর। অনেক বাড়িতেই তাঁদের ছেলেমেয়েরাই প্রথম যাঁদের অক্ষরজ্ঞান হয়েছে। শুধুমাত্র অক্ষরজ্ঞানই হয়েছে তা নয়, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক পাস করে কলেজেও পড়ছেন অনেকে। সে সব পড়ুয়ার একটাই ইচ্ছা— নিজেদের পরিচয় বানানো। সম্প্রতি রাজ্য বাজেট পেশ করার সময়ে বিধানসভায় অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র জানান, কোন পরিবারের বার্ষিক আয় দেড় লক্ষ টাকার কম হলে মেয়ের বিয়েতে নগদ ২৫ হাজার টাকা পাবেন তাঁরা। একটাই শর্ত, মেয়ের বয়স ১৮ বা তার বেশি হতে হবে। ওই প্রকল্পের নাম দেওয়া হয়েছে ‘রূপশ্রী’। প্রশাসনিক সূত্রে জানা গিয়েছে, ওই প্রকল্পের জন্য ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। প্রায় ৬ লক্ষ পরিবার এই প্রকল্পের সুবিধা পাবে।

ইলামবাজারের সে সব গ্রামের আদিবাসী পরিবারগুলিও মেয়ের বিয়ে দিতে রূপশ্রী প্রকল্পের সুবিধা নিতে পারবে। কিন্তু পাত্রীরা ১৮ পেরতেই বিয়েতে রাজি নন। তাঁদের কথায়, ‘‘এত কষ্ট করে যখন এত দূর এগোতে পেরেছি, আর একটু পড়াশোনা করে নিজের একটা পরিচয়ও গড়তে চাই।’’ ইলামবাজার মুরগাবুনির সোনমনি হেমব্রম গত বার উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছেন। এখন একটি বেসরকারি সংস্থা থেকে নার্সিংয়ের ট্রেনিং করছেন তিনি। রাজ্য সরকারের রূপশ্রী প্রকল্পের কথা শুনেছেন তিনি। সোনমনির কথায়, ‘‘কন্যাশ্রী প্রকল্পের টাকা পেয়েছিলাম, তাতে খুব সুবিধা হয়েছিল। রূপশ্রী প্রকল্পও আমাদের মতো পরিবারগুলির জন্য খুব ভালো পদক্ষেপ। কিন্তু ১৮ পেরলেও এখনই বিয়ে করব না। নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে সে কথা ভাবব। তখন রূপশ্রী প্রকল্প কাজে লাগবে।’’ সোনমনির দিদি বাহামনির অল্পবয়সে বিয়ে হয়েছিল। সোমমণি জানান, পারিবারিক অশান্তির জেরে দু’বার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন তার দিদি। এখন অবশ্য পরিস্থিতি বদলেছে। তবে দিদির বিয়ের পর এ রকম অবস্থা থেকেই শিক্ষা পেয়েছেন সোনমনি। তাই ঠিক করেছেন, এখনই বিয়ে নয়। আমখইয়ের মুংলি কিস্কু এখন একাদশ শ্রেণির ছাত্রী। ভবিষ্যতে স্কুলশিক্ষিকা হওয়ার স্বপ্ন দেখে। সেইমতো পড়াশোনায় মন দিয়েছে। সে বলে, ‘‘উচ্চমাধ্যমিক দেওয়ার পরই যদি বাড়ি থেকে বিয়ের জন্য চাপ দেয়, প্রয়োজনে বোলপুর গিয়েও পড়াশোনা করব।’’ পড়াশোনার পাশাপাশি এখন মা-বাবাকে চাষের কাজেও সাহায্য করে সে।

সোনমনি, মুংলিরা উদাহরণমাত্র। এরকম আরও অনেকেই রয়েছেন, যাঁরা ১৮ পেরিয়েই বিয়ে করতে রাজি নন। পরিবারের লোকেরাও তাঁদের এই সিদ্ধান্তে খুশি। তাঁরা জানালেন, রূপশ্রী প্রকল্পের কথা শুনেছেন। বিয়ের খরচে ২৫ হাজার টাকা পাওয়া মানে অনেকটাই। কিন্ত মেয়েরা যখন বিয়ে করতে চাইবে তখনই তাদের বিয়ে দেওয়া হবে। আত্মীয়দের কথায়, ‘‘আমাদের মতো পরিবার থেকে যে ওরা এত দূর এগোতে পেরেছে, এটাই অনেক। বিয়ে দিয়ে ওদের স্বপ্নে বাঁধা দিতে চাই না।’’

ইলামবাজার জঙ্গল সংলগ্ন অঞ্চলে এখন বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা কাজ করছে। তারাও বিভিন্ন ভাবে মেয়েদের স্বনির্ভর করে তোলার চেষ্টা করছে। কাজ করছে চাইল্ড লাইনও। নাবালিকা বিয়ে রুখতে প্রচার চালাচ্ছে জঙ্গলের গ্রামে গ্রামে। তাতে অনেকটা লাভ হয়েছে বলে মনে করছেন সংস্থার সদস্যেরা। ইলামবাজার গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান কৃষ্ণকান্ত হাজরা বললেন, ‘‘আদিবাসী মেয়েরা এখন এগিয়েছে। ওদের মধ্যে স্বনির্ভর হওয়ার ইচ্ছা জেগেছে, যা খুবই ইতিবাচক।’’ তিনি আরও জানান, রূপশ্রী প্রকল্পের আওতাভুক্ত করার ক্ষেত্রেও গ্রামগুলিতে গিয়ে সমীক্ষা চালানো হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Mamata Banerjeee Kanyashree Rupashree Budget
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE