Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
খুনের অভিযোগ কন্ডাক্টর ও খালাসির বিরুদ্ধে

বাসযাত্রীর দেহ মিলল ধানজমিতে

বচসার জেরে এক বাসযাত্রীকে পিটিয়ে খুন করে পাশের ধান জমিতে জল-কাদার মধ্যে ছুড়ে ফেলার অভিযোগকে ঘিরে তপ্ত হয়ে রইল বাঁকুড়ার ইন্দাসের বেলবান্দি। অভিযুক্ত বাস কন্ডাক্টর ও সহকারীকে গ্রেফতারের দাবিতে রবিবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত রাস্তা অবরোধ করলেন বাসিন্দারা।

শোকার্ত: সন্তানদের নিয়ে সুবিচারের আশায় রিক্তা। (ইনসেটে) নিহত আলম শা। নিজস্ব চিত্র

শোকার্ত: সন্তানদের নিয়ে সুবিচারের আশায় রিক্তা। (ইনসেটে) নিহত আলম শা। নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
ইন্দাস শেষ আপডেট: ১৯ মার্চ ২০১৮ ০২:০৭
Share: Save:

বচসার জেরে এক বাসযাত্রীকে পিটিয়ে খুন করে পাশের ধান জমিতে জল-কাদার মধ্যে ছুড়ে ফেলার অভিযোগকে ঘিরে তপ্ত হয়ে রইল বাঁকুড়ার ইন্দাসের বেলবান্দি। অভিযুক্ত বাস কন্ডাক্টর ও সহকারীকে গ্রেফতারের দাবিতে রবিবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত রাস্তা অবরোধ করলেন বাসিন্দারা। পুলিশের বিরুদ্ধেও অভিযোগপত্র গ্রহণ না করার নালিশ তোলেন তাঁরা।

বিকেলে জেলা পুলিশ সুপার সুখেন্দু হীরা দাবি করেন, ‘‘পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ না নেওয়ার কথা ঠিক নয়। তাঁরা থানায় অভিযোগ জানাতে গেলেই তা গ্রহণ করা হবে।’’ ঘটনাচক্রে, এরপরেই ইন্দাস থানার পুলিশ নিহতের পরিজনদের থানায় ডেকে অভিযোগপত্র গ্রহণ করে।

নিহত আলম শা (৩৭) ইন্দাস থানার করিশুণ্ডা গ্রাম পঞ্চায়েতের বেলবান্দি গ্রামের বাসিন্দা। পরিবার সূত্রে জানা যায়, আলম আরামবাগের ত্রিপল সেলাইয়ের একটি কারখানায় কাজ করতেন। প্রত্যেক শনিবার তিনি গ্রামের বাড়িতে আসতেন। বাড়িতে তাঁর স্ত্রী ও মানসিক সমস্যায় থাকা বড় মেয়ে ও দু’টি ছোট ছেলেমেয়ে রয়েছে।

এই সপ্তাহে আলম বিছানার গদি কিনে আরামবাগ থেকে ফিরছিলেন। শান্তাশ্রম রুটের একটি বাসের ছাদে সেই গদি চাপিয়ে তিনি ভিতরে উঠে বসেন। বাড়িতে ফোন করে ছোট ভাই হাকিমকে শান্তাশ্রম বাসস্ট্যান্ডে মোটরবাইক নিয়ে আসতে বলেছিলেন তিনি। কিন্তু তাঁর ফেরা আর হল না।

ক্ষোভ: দেহ আটকে চলছে অবরোধ। নিজস্ব চিত্র

হাকিম জানান, সন্ধ্যায় বাসটি শান্তাশ্রমে আসে। কিন্তু বাস থেকে দাদাকে নামতে না দেখে তিনি চিন্তায় পড়ে যান। ওই বাসেই ছিলেন পাশের কাপশিটের এক মহিলা। হাকিমের অভিযোগ, ‘‘ওই মহিলার কাছে জানতে পারি, খোসবাগ এবং শ্রীপুরের মাঝে আউশনারা গ্রামের কাছে হঠাৎ ঝড় ওঠায় বাসের ছাদ থেকে গদিটি পড়ে যায়। বাস থামিয়ে দাদা গদি কুড়িয়ে আনতে যায়। সেই সময় তাঁর সঙ্গে বাসের কন্ডাক্টর ও খালাসির তুমুল ঝগড়া হয়। তারা দাদাকে মারতে থাকে। যাত্রীরা তাড়া দেওয়ায় তিন জনকেই ফেলে রেখে চালক বাস নিয়ে শান্তাশ্রম বাসস্ট্যাণ্ডে চলে আসে।’’

এরপরেই তিনি মোটরবাইক নিয়ে ঘটনাস্থলের দিকে রওনা দেন। তিনি জানান, আউশনারায় গিয়ে দেখেন, রাস্তার পাশে গদিটা পড়ে আছে। কিন্তু আলমের দেখা নেই। মোটরসাইকেলের আলোয় চারপাশে খোঁজ করেও প্রথমে কিছুই দেখতে পাননি। হঠাৎ রাস্তা থেকে কিছু দূরে দেখেন, ধান জমিতে আলমের দেহ পড়ে রয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘গিয়ে দেখি, কাদার মধ্যে দাদা পড়ে রয়েছে। কোনও সাড় নেই। সঙ্গে সঙ্গে ফোনে গ্রামে খবর পাঠাই। আমার চিৎকারে আশপাশের লোকেরা ছুটে আসে। সবাই ধরাধরি করে দাদাকে রাস্তায় তুলে আনি।’’

সেখান থেকে তাঁরা ইন্দাস ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আলমকে নিয়ে যান। চিকিৎসকেরা পরীক্ষা করে আলমকে মৃত বলে জানান। খবর পেয়ে পুলিশ গিয়ে দেহটি থানায় নিয়ে যায়।

এলাকার বাসিন্দা শেখ ইসলাম, সৈয়দ আবু বক্কর, শেখ ধনুদের দাবি, রাতেই পুলিশের কাছে মৌখিক ভাবে তাঁরা অভিযোগ জানিয়ে আসেন। পুলিশ কাউকে গ্রেফতার না করে বাসটিকে থানায় আটক করে এনে রাখে। আলমের বাবা কেরিম শা ওই বাসের কন্ডাক্টর ও খালাসির বিরুদ্ধে ছেলেকে খুন করার অভিযোগ লেখেন। কিন্তু হাকিমের অভিযোগ, ‘‘রবিবার সকালে থানায় গেলে ডিউটি অফিসার অভিযোগপত্র নিতে চাননি। কেন নেবেন না, সে কারণও জানাতে চাননি। ফের বিকেলে যাওয়া হয়েছিল। কিন্তু পুলিশ ফিরিয়ে দিয়েছে।’’

সেই খবর ছড়িয়ে পড়তেই প্রতিবাদে গ্রামবাসীরা সকালেই বেলাবান্দি রাস্তায় অবরোধ শুরু করেন। এর ফলে শান্তাশ্রম থেকে আরামবাগ, বর্ধমান ও বিষ্ণুপুর রুটে বাস চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। অন্যান্য গাড়িও আটকে থাকে। বাসিন্দাদের অভিযোগ, আটকে পড়ে লোকজন নাজেহাল হলেও পুলিশ কিন্তু অভিযোগপত্র নিতে আসেনি। দুপুরে আলমের দেহ ময়না-তদন্তের পরে অ্যাম্বুল্যান্সে ফিরিয়ে আনা হচ্ছিল। সেই দেহও আটকে রেখে প্রতিবাদ চলে বেশ কিছুক্ষণ। পৌনে ছ’টা নাগাদ পুলিশ থানায় ডেকে অভিযোগপত্র গ্রহণ করার পরে অবরোধ ওঠে।

এ দিকে, মর্মান্তিক খবর শোনার পর থেকেই শোকে পাথর বেলাবান্দি। নিহতের স্ত্রী স্ত্রী রিক্তা বেগম শা কোনওরকমে বলেন, ‘‘ছেলেমেয়েদের টানে সপ্তাহ শেষে বাড়িতে ছুটে আসত মানুষটা। সেই ছুটে আসাই ভাসিয়ে দিয়ে গেল সংসারটাকে? একটা মানুষকে এ ভাবে কেউ পিটিয়ে মারতে পারে? দোষীদের চরম শাস্তি চাই।’’

যদিও বাঁকুড়া জেলা মোটর মজদুর সঙ্ঘের সম্পাদক সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় দাবি করেছেন, ‘‘আজ পর্যন্ত বাঁকুড়া জেলার বাস শ্রমিকদের বিরুদ্ধে এমন মারাত্মক অভিযোগ ওঠেনি। আমার মনে হচ্ছে, কোথাও ভুল হচ্ছে। তদন্ত করলে প্রকৃত তথ্য বেরিয়ে আসবে।’’

তদন্তে কী বেরোয়, বড় মেয়ে মুসকান, পঞ্চম শ্রেণিতে পড়া হাসি ও ছোট্ট ছেলে রিয়াজুলকে আঁকড়ে সেই অপেক্ষায় রয়েছেন রিক্তা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Murder Dead Body Passenger Complaint
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE