Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

শিশু-অপুষ্টি কমলেও মুছবে কবে

বাঁকুড়া জেলার বহু শিশুকে এখনও অপুষ্টির থাবা থেকে বের করে আনতে না পারায়, উদ্বিগ্ন জেলা প্রশাসন। দেখা গিয়েছে, জঙ্গলমহলের তুলনায় জেলার শিল্প ও কৃষিতে উন্নত এলাকাতেই অপুষ্ট শিশুর সংখ্যা বেশি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
বাঁকুড়া শেষ আপডেট: ১৫ নভেম্বর ২০১৭ ০১:১৫
Share: Save:

শিশু দিবসে স্কুলে স্কুলে নানা অনুষ্ঠানে খুদে পড়ুয়াদের মুখে খুশি উপচে পড়ছে। প্রশাসন থেকে বিভিন্ন ক্লাবের অনুষ্ঠানে ছোটরা নাচ-গান করে সবাইয়ের তাক লাগিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু এটাই সব নয়। বাঁকুড়া জেলার বহু শিশুকে এখনও অপুষ্টির থাবা থেকে বের করে আনতে না পারায়, উদ্বিগ্ন জেলা প্রশাসন। দেখা গিয়েছে, জঙ্গলমহলের তুলনায় জেলার শিল্প ও কৃষিতে উন্নত এলাকাতেই অপুষ্ট শিশুর সংখ্যা বেশি। জেলাশাসক মৌমিতা গোদারা বসু বলেন, ‘‘প্রতি মাসেই জেলার ব্লক ভিত্তিক অপুষ্ট শিশুর রিপোর্ট নিয়ে আলোচনা করে কোন পথে তাদের উন্নতি করা যাবে, তার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।’’ তিনি জানান, অপুষ্টি-মুক্ত বাঁকুড়া গড়াই প্রশাসনের লক্ষ্য।

প্রশাসন তথ্য দিয়ে গত কয়েক বছরে ধাপে ধাপে অপুষ্ট শিশুর সংখ্যা এই জেলায় কমছে বলে দাবি করলেও, স্বাধীনতার সাত দশক পার করেও ওই সংখ্যাটা নেহাত কম নয়। তাই আত্মতুষ্টির কোনও কারণ নেই বলে প্রকারান্তরে মানছেন প্রশাসনের কিছু কর্তাও। তাঁরা জানাচ্ছেন, অপুষ্টি দূর করতে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে জেলা প্রশাসনের অন্দরে।

প্রশাসন সূত্রে দাবি করা হয়েছে, গত পাঁচ বছরে বাঁকুড়ায় অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা অনেকটাই কমানো গিয়েছে। ২০১২ সালের অক্টোবর মাসে যেখানে জেলায় অপুষ্ট শিশুর সংখ্যাটা ছিল ১১ হাজার ২০৯, চলতি বছরের অক্টোবরে সেই সংখ্যাটা নেমে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ২২৭-এ। গত অক্টোবর মাস পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বড়জোড়া ব্লকে অপুষ্ট শিশুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি (২৩২)। তারপরেই রয়েছে পাত্রসায়র (২২৬), বিষ্ণুপুর (২১৩), গঙ্গাজলঘাটি (২০২), ওন্দা (১৯৪)। জেলার জঙ্গলমহলের ব্লক রাইপুরে ১৮৯, রানিবাঁধে ১৬৮, সারেঙ্গায় ১১৬ ও সিমলাপালে ৬৭ জন অপুষ্ট শিশু রয়েছে।

সার্বিক ভাবে জেলায় অপুষ্ট শিশুর সংখ্যা ধাপে ধাপে কমার জন্য সাধারণ মানুষের সচেতনতা ও প্রশাসনের সক্রিয়তাকেই কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে। বাঁকুড়ায় শিশু স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা পজিটিভ ডিভিয়েন্স সেলের জেলা কো-অর্ডিনেটর ববিতা হাজরা দাবি করেন, “গত কয়েক বছরে সাধারণ মানুষের মানসিকতার অনেকটাই বদল ঘটানো গিয়েছে। এই জেলার প্রত্যন্ত এলাকায় দেখেছি, শিশুদের রাতে খাবার না খাইয়েই ঘুম পাড়িয়ে দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। গর্ভবতী মহিলারাও খাবার বিষয়ে তেমন সচেতন ছিলেন না।”

তিনি জানাচ্ছেন, ২০১২ সাল থেকে স্বাস্থ্য দফতরের উদ্যোগে এই জেলার রানিবাঁধ, রাইপুর, সিমলাপাল, সারেঙ্গা, হিড়বাঁধ ও ছাতনায় মোট ছ’টি ‘নিউট্রিশন রিহ্যাবিলিটি সেন্টার’ গড়ে উঠেছে। অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলি অতি অপুষ্ট শিশু ও তাদের মায়েদের ওই সেন্টারে পাঠায়। সেখানে মা ও শিশুকে সুষম আহার দেওয়া হয়। এমনকী দৈনিক ওই শিশুর মাকে একশো টাকা করে ভাতা দেওয়া হয়। শিশুটির ওজন স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত ওই সেন্টারেই তাকে রাখা হয়। এই উদ্যোগ অপুষ্টি দূর করতে বড় ভূমিকা নিয়েছে।

জানা গিয়েছে, বছর দুয়েক আগে থেকে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলিতে ছাতু ও চিনির লাড্ডু তৈরি করে শিশুদের দেওয়া শুরু হয়েছে। এতে শিশুদের ওজন বাড়তে সাহায্য করছে। এ ছাড়া বাঁকুড়ার জেলাশাসক মৌমিতা গোদারা বসুর উদ্যোগে অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের বাড়িতে একশো দিনের প্রকল্পে ‘কিচেন গার্ডেন’ তৈরি করে দিয়ে ওই পরিবারগুলিকে স্বনির্ভর করার প্রকল্পও নেওয়া হয়েছে ২০১৬ সাল থেকে। একশো দিন কাজের জেলা প্রকল্প আধিকারিক সুপ্রভাত চট্টোপাধ্যায় জানান, বর্তমানে জেলার ২২টি ব্লকের ৯৭৪টি অপুষ্ট শিশুর পরিবার জেলাশাসকের ওই প্রকল্প থেকে সুবিধা পাচ্ছেন।

বিডিও (ওন্দা) শুভঙ্কর ভট্টাচার্য জানান, ২০১৬ সালে ওন্দা ব্লকের ১৭৬টি অপুষ্ট শিশুর বাড়ির উঠোনে কলাগাছ, পালং ও নটে শাক-সহ আনাজের চারা লাগিয়ে ‘কিচেন গার্ডেন’ তৈরি করে দেওয়া হয়েছিল। অনেককেই পোল্ট্রি ফার্ম, ছাগল প্রতিপালন ও মাছ চাষেও সাহায্য করা হয়েছিল ওই প্রকল্পে। ঘরের তৈরি ফসল ও মাছ খেয়ে কিছু ক্ষেত্রে অপুষ্টি দূর হয়েছে। ধাপে ধাপে আরও কয়েকটি পরিবারকে ওই প্রকল্পে আনা হচ্ছে। তিনি বলেন, “প্রকল্প গড়ে দেওয়ার পাশাপাশি আমরা ওই পরিবারগুলির খোঁজ খবরও রাখছি।”

জেলা শিশু কল্যাণ আধিকারিক নরেন্দ্রনাথ হালদার বলেন, “বিভিন্ন অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের অপুষ্ট শিশুদের আমরা বিশেষ ভাবে নজরে রাখছি। ওই শিশুদের প্রতি মাসের ওজন, শারীরিক অবস্থার পরিবর্তন জানার পাশাপাশি ছবিও তুলে রাখা হচ্ছে।’’

জেলাশাসক বলেন, “অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের খাবারের পাশাপাশি অপুষ্ট শিশুদের বাড়িতেই পুষ্টিকর ফল বা আনাজের চাষ করা গেলে তা সহজলভ্য হবে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী চান অপুষ্টি থেকে মুক্তির জন্য সরকারি প্রকল্পগুলিকেও কাজে লাগানো হোক। সেই লক্ষ্যেই আমরা এগোচ্ছি।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Malnutrition Children
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE