জমজমাট: পুরুলিয়া শহরের বড়হাটে পরবের আগে মাছের বিক্রিবাটা। সোমবার। ছবি: সুজিত মাহাতো
খালেই পরব, সিনালেই সাঁকরাত। বাংলা করলে দাঁড়ায়— খাওয়া মানেই পরব, আর স্নান মানেই সংক্রান্তি। উৎসবের পুরুলিয়ার মেজাজটা এখন এমনই।
সরস্বতী পুজোর পরের দিন গোটা মানভূম জুড়ে অরন্ধন ষষ্ঠী হয়। সেই পুজোর প্রধান উপচার মাছ। কানু বিনা যেমন গীত হয় না, তেমনই মাছ ছাড়া অরন্ধন ষষ্ঠীর কথা ভাবতেই পারে না পুরুলিয়া। প্রায় প্রতি বছরই আগের বছরের রেকর্ড ভাঙে মাছের বিক্রি। এ বারে, রবি আর সোমবার মিলিয়ে অন্য দিনের থেকে প্রায় ছ’গুন মাছ বিক্রি হয়েছে জেলায়।
কালিয়া থেকে সর্ষের ঝাল, বা তেলে-ঝোলে আজ মানভূমে মাছের উৎসব।
পুরুলিয়া শহরের বড় হাট থেকে জেলার বলরামপুর, মানবাজার, বান্দোয়ান, ঝালদা, বাঘমুণ্ডি, বরাবাজারের মতো বিভিন্ন প্রান্তের বাজারে মাছ যায়। পাইকারি মাছের ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, অন্য সময়ে এই বাজারে দু’দিনে দু’টনের কম মাছ লাগে। রবি আর সোমবার প্রায় ৮-৯ টন মাছ বিক্রি হয়েছে। বড় হাটের পাইকারি মাছ ব্যবসায়ী সাধন ধীবর বলেন, ‘‘অন্য সময়ে আমার ৪০ কেজি ওজনের ১০ ট্রে হলেই হয়ে যায়। এখন অর্ডার-ই রয়েছে ১২০ ট্রে-র।’’
আব্দুল জব্বর নামে আরেক ব্যবসায়ী জানাচ্ছেন, অন্যদিন ৫-৬ ট্রে মাছ আনান। এই দু’দিনে লেগেছে প্রায় ২৫ ট্রে। শিল্পা ধীবরকে সাধারণ দিনে আনাতে হয় খান কুড়ি ট্রে। এখন চাহিদা দাঁড়িয়েছে প্রায় দু’শো ট্রে-র। এটা গেল শুধু চালানি মাছের কথা। এর সঙ্গে যোগ হবে দেশি মাছের আমদানি।
খুচরো বাজারের ছবিটাও একই রকমের। বড় হাটের খুচরো মাছ বিক্রেতা বাচ্চু ধীবর বলেন, ‘‘আমার অন্যদিন ২০ থেকে ৩০ কেজি বিক্রি হয়। এই দু’দিনে দেড় কুইন্টাল বিক্রি হয়েছে।’’ লিন্টু ধীবরের কাটতি থাকে ৩০-৩৫ কেজি। বিক্রি হয়েছে দু’কুইন্টাল।
তবে এই ক’দিন কদর শুধু রুই, কাতলা বা মৃগেলের মতো মাছের। ইলিশ বা চিংড়ি বিশেষ পাত্তা পায় না। খুচরো মাছ বিক্রেতা মহম্মদ রাজু জানান, চালানি মাছের দাম এ বার বিশেষ বাড়েনি। তবে দেশি রুই কাতলার দর এই ক’দিন বেশ কিছুটা চড়া।
কিলো দুয়েকের দেশি রুইয়ের দর সোমবার ছিল প্রায় সাড়ে তিনশো টাকা করে। মাপে ছোট হলেও আড়াইশোর নীচে রুই মেলেনি। কাতলাও তথৈবচ। একই মাপের মৃগেলের ৩০০ থেকে ৩২০ টাকা কিলো। চারাপোনা ২০০ থেকে ২৪০ টাকা কেজি। ইলিশ এবং চিংড়ির দাম ছিল অন্য দিনের মতোই। কিন্তু বিশেষ কেউ সে দিকে ফিরে তাকাননি।
কথিত আছে, জঙ্গলের রাস্তায় ছদ্মবেশে পড়ে থাকা দেবী ষষ্ঠীকে চিনতে পারেননি এক রাজা। তাঁর অনুরোধ কানেই তোলেননি। দেবীর রাগে রাজার ষাট সন্তানের মৃত্যু হয়। পরে অবশ্য ষষ্ঠীর কৃপাতেই বেঁচে ওঠে তারা। সেই দিন আনন্দে সবাই রান্না করতেই ভুলে গিয়েছিলেন। আগের দিনের বেঁচে থাকা খাবার খান। সন্তানের মঙ্গল কামনায় রাঢ়বঙ্গ জুড়ে পালিত হওয়া এই আচারের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এই লোকশ্রুতি। পরবে পান্তা ভাত একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাচার। তবে মাছের সঙ্গে পরবের সরাসরি যোগ নেই।
তা না থাকুক। পুরুলিয়ায় এ যেন মাছেরই উৎসব। দর যতই হোক, ক্রেতারা বাজার করছেন থলে ভরে। পুরুলিয়া শহরের বাসিন্দা দেবকুমার দাঁ বলেন, ‘‘এই পরবে অনেকটাই মাছ লাগে। মাছেরই তো পরব।’’ শহরের বাসিন্দা সঞ্জীব দত্ত বলেন, ‘‘অন্য সময়ে আমাদের বাড়িতে যা মাছ লাগে, পরবের দিন তার ছ’গুন লাগে।’’
ঝালদার বধূ প্রতিমা সেন জানান, ছ’শো মাছ হলেই এমনিতে চলে যায়। কিন্তু সোমবার কিনেছেন সাড়ে চার কেজি মাছ।
প্রস্তুতি শেষ। আজ, পুরুলিয়ার হেঁসেলে হেঁসেলে জমজমাট উৎসব।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy