Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
পাত্রসায়রে হাতির হানা

আলু পাহারা দিতে গিয়ে মৃত্যু চাষির

ভোরের দিকে হাতিটি নারায়ণপুর পঞ্চায়েতের দেউলপাড়া গ্রাম থেকে দামোদর নদী পার হয়ে পানাগড়ের জঙ্গলে চলে গিয়েছে। তবে ওই ঘটনার পরে এলাকার বাসিন্দাদের সতর্ক করতে মাইকে প্রচার করা হচ্ছে বলে বন দফতর সূত্রে খবর।

শোক: বলাই রায়ের দেহ ঘিরে পরিবার। নিজস্ব চিত্র

শোক: বলাই রায়ের দেহ ঘিরে পরিবার। নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
পাত্রসায়র শেষ আপডেট: ১৬ মার্চ ২০১৮ ০০:৪৫
Share: Save:

আবার হাতি কেড়ে নিল একটি প্রাণ। এ বার পাত্রসায়রে। চোরের হাত থেকে আলুর বস্তা রক্ষা করতে গিয়ে হাতির হানায় বেঘোরে মৃত্যু হল এক বৃদ্ধের। বুধবার রাতের ঘটনা। পুলিশ জানিয়েছে, মৃতের নাম বলাই রায় (৬৫)। তিনি পাত্রসায়র থানার কাঁঠালঘাটা গ্রামের মাঝপাড়ার বাসিন্দা। খবর পেয়ে বৃহস্পতিবার সকালে পুলিশ গিয়ে দেহ উদ্ধার করে।

বাঁকুড়ার জেলা পুলিশ সুপার সুখেন্দু হীরা বলেন, ‘‘বলাইবাবুর দেহ ময়না-তদন্তের জন্য বিষ্ণুপুর হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে।’’ তাঁর পরিবারকে ক্ষতিপূরণ বাবদ আড়াই লক্ষ টাকা দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন বন-কর্তারা। ঘটনার পরেই হাতিটি দামোদর নদ পেরিয়ে পশ্চিম বর্ধমানের পানাগড়ে চলে যায়।

কিন্তু তাতে ক্ষোভ কমছে না মৃতের পরিজন ও গ্রামবাসীর। বাঁকুড়া উত্তর বন বিভাগেরই বেলিয়োতোড়ের বৃন্দাবনপুর বিটের জঙ্গলে সোমবার সন্ধ্যায় জমি দেখতে দিয়ে হাতির হানায় মৃত্যু হয় এক বৃদ্ধের। পরের দিন সকালেই পাশের রাধানগর রেঞ্জের সোনামুখী থানার ইছারিয়ার জঙ্গলে জ্বালানি কুড়োতে যাওয়া এক প্রতিবন্ধীকে তাড়া করে শুঁড়ে ছুঁড়ে জখম করে একটি হাতি। বুধবার সোনামুখীরই ইন্দকাটা বিটের জঙ্গলে বন দফতরের গাছ লাগাতে গিয়ে হাতির হানায় জখম হন এক যুবক। তারপরে সেই রাতেই পাত্রসায়রের কাঁঠালঘাটা গ্রামে ওই বৃদ্ধকে মারে একটি হাতি। লাগাতার হাতির হানায় ক্ষুব্ধ জঙ্গল লাগোয়া গ্রামের বাসিন্দারা।

বৃহস্পতিবার সকালে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, গ্রাম লাগোয়া আলুর খেতে বলাইবাবুর দেহ ঘিরে পরিজনেরা কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। তাঁর স্ত্রী মালতি রায় বলছিলেন, ‘‘রাতে সুস্থ সবল মানুষটা খাওয়াদাওয়া করে জমি পাহারা দিতে গেল। কিন্তু তারপর যে এমন মর্মান্তিক পরিণতি অপেক্ষা করছিল, ভাবতে পারিনি।’’

মৃতের বড়ছেলে বাউল জানান, বুধবার তাঁদের জমি থেকে আলু তোলা হয়েছিল। তিন বিঘা জমিতে ১৮০ বস্তা আলু হয়েছে। দামও ভাল পেয়েছেন। কিন্তু রাতে জমিতে আলুর বস্তা পড়েছিল। পাছে চোর এসে আলুর বস্তা তুলে নিয়ে যায়, সে জন্য তাঁর বাবা পাহারা দিতে গিয়েছিলেন। তাঁর আক্ষেপ, বারণ করা সত্ত্বেও বলাইবাবু কথা শোনেননি। আলুর পাশে ত্রিপলের তাঁবুতে রাতে তিনি ছিলেন। তাঁর কথায়, ‘‘এলাকায় যে হাতি ঢুকেছে, সে ব্যাপারে বন দফতর মাইকে কোনও প্রচারই করেনি। সকালে গ্রামের বিধান দিগরের মাটির বাড়ি হাতিতে ভেঙে দিয়েছে শুনেই মনে কু-ডাকে। বাবা বাড়ি না ফেরায় মাঠে ছুটে যাই। গিয়ে দেখি বাবার নিথর দেহ পড়ে রয়েছে। বাবার হাতে-পায়ে হাতির পায়ের ছাপ। তখনই বুঝে যাই, রাতে গ্রামে ঢোকা হাতিটাই বাবাকে মেরেছে।’’

তাঁর আক্ষেপ, গত বছর বছর আলুর দাম পাননি। ব্যাঙ্কে লক্ষাধিক টাকার ঋণ। প্রায়ই ব্যাঙ্কের লোকেরা বাড়িতে এসে ঋণ শোধ করার জন্য চাপ দিচ্ছিল বলে তাঁর দাবি। এরই মধ্যে এ বার পরিবারের গয়না বন্ধক দিয়ে আলু চাষ করেছিলেন তাঁরা বাবা-ছেলে। ভাল দাম ওঠায় তাই স্বস্তি পেয়েছিলেন। কিন্তু শান্তি উধাও হয়ে গেল এই ঘটনায়।

ভাল কীর্তন গাইয়ে হিসেবে বলাইবাবুর এলাকায় নামডাক ছিল। নিজের দল নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় তিনি অনুষ্ঠান করতে যেতেন। প্রতিবেশী স্বরূপ রায়, মুক্ত দিগর, নিমাই মিদ্দাদের কথায়, ‘‘সকালে তাঁর গানেই অনেকের ঘুম ভাঙত। জমিতে তেমন খাটতেও পারতেন।’’

বন দফতর কেন এলাকায় হাতি ঢোকার খবর আগাম দেয়নি, তা নিয়ে ক্ষোভ উগরে দেন তাঁরা। মৃতের দুই ছেলে বাউল ও বিদ্যুৎ প্রশ্ন ছোড়েন— ‘‘হাতি আর ক’জনের প্রাণ কাড়লে টনক নড়বে বন দফতরের?’’

বন দফতরের কর্তারা অবশ্য দাবি করেছেন, বুধবার রাতে তাঁরা এলাকায় ঢোকা দু’টি হাতির উপরে নজরে রাখছিলেন। ছিলেন এডিএফও (বাঁকুড়া উত্তর) মধুসূদন মণ্ডল, সোনামুখীর রেঞ্জ অফিসার শুভাশিস চক্রবর্তী, পাত্রসায়রের রেঞ্জ অফিসার পৃথ্বীশ ঘোষ প্রমুখ। পৃথ্বীশবাবু বলেন, ‘‘স্কোয়াড নিয়ে আমরা বুধবার রাত দু’টো পর্যন্ত জঙ্গলে দু’টি হাতির উপরে নজরে রেখেছিলাম। একটি হাতি নদী পেরিয়ে বিষ্ণুপুর পাঞ্চেত ডিভিসনের বিষ্ণুপুর রেঞ্জের কোশির বাগানে চলে যায়। কিন্তু অন্য হাতিটি আমাদের স্কোয়াডের পিছন দিকে চুপি সারে বেরিয়ে যায় পাত্রসায়ের রেঞ্জের মরা চৈতির জঙ্গলে। অত বড় জঙ্গলে পায়ের ছাপ দেখে হাতিটাকে নজর করতে পারা যায়নি। তারই মধ্যে এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গেল।’’

ভোরের দিকে হাতিটি নারায়ণপুর পঞ্চায়েতের দেউলপাড়া গ্রাম থেকে দামোদর নদী পার হয়ে পানাগড়ের জঙ্গলে চলে গিয়েছে। তবে ওই ঘটনার পরে এলাকার বাসিন্দাদের সতর্ক করতে মাইকে প্রচার করা হচ্ছে বলে বন দফতর সূত্রে খবর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Potato grower Potato dead
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE