Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

পাঁচ বছরেই ভোল বদল বামুনডিহার

এই পরিবর্তনের কাণ্ডারী গ্রামেরই ছেলে আংশিক সময়ের কলেজ শিক্ষক দেবীলাল মাহাতো। গ্রামের উন্নয়নে তিনি কম বয়সিদের নিয়ে গড়ে তুলেছেন ‘চলো এগিয়ে যাই’ নামে একটি সংগঠন। ঢাল-তলোয়ারহীন হলে তাঁরা নিধিরাম সর্দার হতে নারাজ।

তুলি হাতে দেবীলাল। ছবি: সুজিত মাহাতো

তুলি হাতে দেবীলাল। ছবি: সুজিত মাহাতো

প্রশান্ত পাল
পুরুলিয়া শেষ আপডেট: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০১:১৪
Share: Save:

পায়ে চলার চার কিলোমিটার আলপথ পেরিয়ে তবেই পৌঁছনো যেত পাকা রাস্তায়। সন্ধ্যা নামলে গাঁয়ের ঘরে ঘরে জ্বলে উঠত কুপির আলো। বছরের পর বছর এ ভাবেই চলছিল আড়শার কংসাবতী নদী ঘেঁষা বামুনডিহার জীবন। এ বার গ্রামের এক পাল ছেলের হাত ধরেই বদলাতে শুরু করেছে সেই বামুনডিহা।

আলপথ বদলে গিয়েছে পাকা রাস্তায়। কুপি নয়, এখন ঘরে ঘরে জ্বলছে বিদ্যুতের আলো, চলছে টিভি, ঘুরছে ফ্যান। কেউ যাতে স্কুল ছুট্‌ না হয়, সে জন্য অভিভাবক ও শিক্ষকদের নিয়ে বৈঠকে বসে বোঝানো হচ্ছে। সচেতন করতে রাস্তার দু’পাশে বিদ্যুতের খুঁটিতে লেখা হয়েছে, সরকারি প্রকল্পের সুবিধার কথা, গাছ লাগানোর বার্তাও। এক সময়ে এই গ্রামের নাম শুনলে যাঁরা ‘প্রত্যন্ত এলাকা’ বলে নাক সিঁটকোতেন, তাঁরাই এখন পাঁচ বছরে বদলে যাওয়া বামুনডিহা দেখতে আসছেন।

এই পরিবর্তনের কাণ্ডারী গ্রামেরই ছেলে আংশিক সময়ের কলেজ শিক্ষক দেবীলাল মাহাতো। গ্রামের উন্নয়নে তিনি কম বয়সিদের নিয়ে গড়ে তুলেছেন ‘চলো এগিয়ে যাই’ নামে একটি সংগঠন। ঢাল-তলোয়ারহীন হলে তাঁরা নিধিরাম সর্দার হতে নারাজ। দেবীলালের কথায়, ‘‘গ্রামের হতশ্রী দশা দেখে দাদার বিয়ে ভেঙে যেতে বসেছিল। আমিই বলেছিলাম, ক’বছরে গ্রাম বদলে দেব। সেই জেদটাই সবার মধ্যে ছড়িয়ে কাজ করে যাচ্ছি।’’

প্রশাসনের খাতায়, বাম আমলে আড়শার পিছিয়ে পড়া গ্রামের তালিকার প্রথম সারিতে ছিল বামুনডিহা। রাজ্যে পালাবদলের পরে মুখ্যমন্ত্রী জঙ্গলমহলের পিছিয়ে পড়া গ্রামগুলির উন্নয়ন করতে চান শুনে সে সময়ের কলেজ পড়ুয়া দেবীলাল গ্রামবাসীদের নিয়ে ব্লক অফিস খেরে পুরুলিয়ায় জেলা পরিষদে দাবি জানান। পুরুলিয়ায় কলেজে পড়তেন বলে গ্রামের রাস্তার জন্য তদ্বির করতে মাঝে মধ্যেই তিনি চলে যেতেন জেলা পরিষদে। প্রধানমন্ত্রী সড়ক যোজনায় বামুনডিহার নাম উঠল।

ঠিকাদার এলে তরুণেরা তাঁকে জানিয়েছিলেন, কেউ কিচ্ছু চাইবে না। শুধু রাস্তাটা পাকাপোক্ত চাই। একই ভাবে দেবীলাল পুরুলিয়া শহরের গ্রামীণ বিদ্যুদয়ন প্রকল্পের অফিসে দিয়ে বার বার বিদ্যুৎ দেওয়ার দাবি জানাতে থাকেন। রাস্তা তৈরির কয়েক মাসের মধ্যে গ্রামে বিদ্যুতের খুঁটি পড়ে। গ্রামের ছেলেরাই শ্রমিকের কাজ করেছিলেন। ২০১২-র ৪ এপ্রিল বামুনডিহায় জ্বলে ওঠে বিদ্যুতের আলো। ‘চলো এগিয়ে যাই’-এর সদস্য রঞ্জিত মাহাতো, বিশ্বজিৎ মাহাতোদের কথায়, ‘‘যে দিন আমাদের গ্রামে বিদ্যুৎ এল, সে দিন যে আমাদের কত আনন্দ হয়েছিল, বলে বোঝানো যাবে না। মনে হয়েছিল অভিশাপমুক্ত হল গ্রাম।’’

এখানে থেমে যায়নি ‘চলো এগিয়ে যাই’। স্কুলে ছেলেমেয়েরা ভর্তি হলেও উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন সে ভাবে কেউ দেখত না। কিছু দূর পড়াশোনা করেই পাট চুকিয়ে দিত। অভিভাবক ও গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকদের বৈঠকে বসিয়ে পড়াশোনার প্রয়োজনীয়তার কথা তাঁরা বোঝান। প্রতি ছ’মাস অন্তর সেই বৈঠক চলছে। সেখানে গ্রামের উন্নয়নের রূপরেখাও তৈরি হয়।

সবাইকে নিয়ে রাস্তার পাশে নিম, ছাতিম, শিমূলের মতো নানা রকমের গাছ লাগানো হয়েছে। সবাই মিলে জল দিতেন। সেই সব গাছ এখন বেড়ে উঠেছে। গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক রামেশ্বর সিংহ সর্দার বলেন, ‘‘স্কুলে এখন স্কুলে পড়ুয়ার সংখ্যা বেড়েছে। দেবীলাল ও তাঁর সঙ্গীরা গ্রামের পরিবেশটাই পাল্টে দিয়েছেন।’’ ওই স্কুলে এক সময়ে শিক্ষকতা করতেন শান্তুনু চক্রবর্তী। তিনি বলেন, ‘‘চেষ্টা করলে একটা গ্রাম যে এত তাড়াতাড়ি বদলাতে পারে, তা বামুনডিহা করে দেখাচ্ছে। এখন তো গ্রামে স্বাধীনতা দিবসের মতো বিশেষ দিনগুলোও পালিত করা হয়।’’

এলাকার জেলা পরিষদ সদস্য সুষেণচন্দ্র মাঝির কথায়, ‘‘আদর্শ গ্রাম গড়ে তুলতে দেবীলালদের নিরলস প্রচেষ্টা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। অন্য গ্রামগুলিতে যদি এ রকম কয়েকটা ছেলেপিলে থাকত, তাহলে আপনাআপনিই বদলে যেত সব গ্রাম।’’ দেবীলালের বৌদি ভাগ্য মাহাতো থেকে পড়শি বধূ সুগা মাহাতোরা বলছেন, ‘‘বাপের বাড়ি থেকে এই গ্রামে বিয়ে দিতে আপত্তি করেছিল ঠিকই। এখন তাঁরাই গ্রামের উন্নতির কথা সবাইকে বলে বেড়ান।’’

তবে থামতে নারাজ চলো এগিয়ে যাই-র সদস্যেরা। গ্রামে ১৩০টি পরিবারের মধ্যে মোটে ৮০ জনের শৌচালয় রয়েছে। তাও অনেকে ব্যবহার করতে চান না। তাই দেবীলালেরা ঠিক করেছেন, গ্রামের সব বাড়িতে শৌচালয় তৈরি করে তাঁরা নির্মল গ্রাম গড়বেন। নির্মল গ্রাম গড়তে এ বার জেলাশাসকের কাছে যাওয়ার ভাবনা রয়েছে তাঁদের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Wall graffiti awareness messages Bamundiha
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE