Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

আমলা কী, বোঝাতে কর্মশালা

আইএএস, আইপিএস হয়ে জেলার দায়িত্ব সামলাচ্ছেন যাঁরা, তাঁরাই আগামী প্রজন্মকে বোঝাতে চাইছেন, আরও পথ রয়েছে। আগামী ৫ ডিসেম্বর দিনভর বাঁকুড়ার রবীন্দ্রভবনে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে একটি কর্মশালা হবে। কলেজ প়ড়ুয়া বা কলেজ উত্তীর্ণ ছাত্রছাত্রীরা সেখানে যোগ দিতে পারবেন।

রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
বাঁকুড়া শেষ আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০১৭ ০৬:৪০
Share: Save:

হয় ডাক্তার নয় ইঞ্জিনিয়ার। স্কুলের পরীক্ষায় ভাল করলে ভবিষ্যত গড়ে তোলার ব্যাপারে এটাই রেওয়াজ। অভিভাবক, আত্মীয়স্বজন, শিক্ষক, ফটোকপির দোকানদার— চারপাশে আর যাঁরা থাকেন, মোটের উপরে সবাই মিলেই কানের মাথা খেয়ে এটাই বুঝিয়ে ছাড়েন। আর দশচক্রে বর্ষে বর্ষে দলে দলে বিদ্যামঠতল থেকে প্রচুর পড়ুয়া গিয়ে নাম লেখাচ্ছে জয়েন্টের কোচিং-এ। তাদের কারও হয়তো ভাষার উপরে দখলও রয়েছে খুব ভাল, কারও এলেম রয়েছে আঁকায়। আবার কারও হয়তো চারপাশকে দেখার চোখ জহুরির মতো— সমাজবিজ্ঞানের বইপত্র পড়লে সেটায় শান পড়তো আরও। কিন্তু সে সব হওয়ার জো নেই। হয় ডাক্তার নয় ইঞ্জিনিয়ার।

প্রায় আপ্তবাক্য হয়ে গিয়েছে যেন এটি। আর বাঁকুড়া জেলা প্রশাসন সেটাই ভাঙতে চাইছে। আইএএস, আইপিএস হয়ে জেলার দায়িত্ব সামলাচ্ছেন যাঁরা, তাঁরাই আগামী প্রজন্মকে বোঝাতে চাইছেন, আরও পথ রয়েছে। আগামী ৫ ডিসেম্বর দিনভর বাঁকুড়ার রবীন্দ্রভবনে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে একটি কর্মশালা হবে। কলেজ প়ড়ুয়া বা কলেজ উত্তীর্ণ ছাত্রছাত্রীরা সেখানে যোগ দিতে পারবেন।

বাঁকুড়া জেলাশাসক মৌমিতা গোদারা বসু বলেন, “প্রশাসনিক ক্ষেত্রের চাকরির ব্যাপারে নতুন প্রজন্মকে সচেতন করাই আমাদের লক্ষ্য। এই পেশায় সম্মান রয়েছে। ভাল ভবিষ্যৎ গড়ার সুযোগও আছে। দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রেও বড় ভূমিকা নেওয়া যায়।’’ তিনি জানান, সিভিল সার্ভিসের পরীক্ষায় সফল হতে কী ভাবে পড়াশোনা করা দরকার, সিলেবাস কেমন হয় সেই সমস্ত খুঁটিনাটি আলোচনা হবে কর্মশালায়। বোঝানো হবে, প্রশাসনিক কর্তাদের কাজকর্ম কেমন হয় সেটাও।

মৌমিতাদেবী বলেন, “মেধাবী পড়ুয়াদের সিভিল সার্ভিসে বিশেষ আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। সে কথা ভেবেই আমরা এই কর্মশালার আয়োজন করেছি।”

কর্মশালার জন্য নাম নথিভুক্ত করা শুরু হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যেই। জেলার প্রতিটি ব্লক অফিস এবং জেলা সর্বশিক্ষা মিশন দফতরে ইচ্ছুক তরুণ-তরুণীদের গিয়ে আবেদনপত্রের জন্য যোগাযোগ করতে হচ্ছে। সাড়াও মিলছে ভাল।

ঘটনা হল, বাঁকুড়া জেলা পুলিশের উদ্যোগে ২০১৬ সাল থেকে ‘সোপান’ প্রকল্পে জেলা সদর, বিষ্ণুপুর ও খাতড়া থানায় সরকারি চাকরির স্টাডি সেন্টার গড়া হয়েছে। সেখানে উৎসাহীরা দরকারি বইপত্র পড়ার সুযোগ পান। খাতড়া টাউন লাইব্রেরির সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে এসডিপিও (খাতড়া) বিশপ সরকার সরকারি চাকরির প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু করেছেন। বিষ্ণুপুরেও পুলিশের উদ্যোগেও একটি প্রশিক্ষণ শিবির চালু হয়েছিল। তবে বর্তমানে সেটি বন্ধ। অনেক ছাত্রছাত্রীকে সরকারি চাকরির প্রশিক্ষণ দিচ্ছে বাঁকুড়া রামকৃষ্ণ মিশনও। কিন্তু এই সমস্ত কিছুর পরেও যুব সমাজের উৎসাহ যে বিশেষ বাড়ছে, এমনটা নয়।

কেন? অনেকে বলছেন এই সমস্ত পরীক্ষা কঠিন বলে। সদ্য বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেছেন পানাগড়ের সৌম্যদীপ ঘোষ। তিনি বলেন, “আইএএস বা আইপিএস পরীক্ষা বেশ জটিল বলেই মনে হয়। তার চেয়ে উচ্চমাধ্যমিকের পরে এমবিবিএস পড়ে বেরিয়ে গেলে নিশ্চিত রোজগারের সুযোগ রয়েছে।”

তবে বাঁকুড়ার পুলিশ সুপার সুখেন্দু হীরা বলছেন, “বিভিন্ন লোকজনের সঙ্গে কথা বলে বুঝেছি, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা শিক্ষকতার পেশা নিয়ে সবাই যতটা ওয়াকিবহাল, আমলা বা পুলিশের চাকরি নিয়ে তেমনটা নন।’’ এই না জানার ব্যাপারটাতেই গুরুত্ব দিচ্ছেন বাঁকুড়া জেলা স্কুলের শিক্ষক বারিদবরণ মিশ্রও। তিনি বলেন, “অভিভাবকদের অনেকে তো বটেই, এমনকী অনেক শিক্ষকও জানেন না প্রশাসনিক চাকরিকে পেশা হিসেবে নিতে গেলে কোন পথে এগোতে হবে। সমস্যাটার শুরু সেখান থেকেই।”

বাঁকুড়া সারদামণি গার্লস কলেজের অধ্যক্ষ সিদ্ধার্থ গুপ্ত বলেন, “চিরাচরিত বিষয়ে পড়াশোনার হারটাই খুব কমে যাচ্ছে। রাজ্যের কলেজগুলির চল্লিশ শতাংশের বেশি আসনই খালি পড়ে রয়েছে।” রাজ্যের নামডাকওয়ালা বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন খালি পড়ে থাকার কথাও বিভিন্ন সময়ে উঠে এসেছে খবরে। সিদ্ধার্থবাবুর মতে, এই পরিস্থিতিতে অধিকাংশ অভিভাবকই ভাবছেন, এক বার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াতে পারলেই ছেলেমেয়ের ভবিষ্যত অনেকটা নিশ্চিত হয়ে যাবে। কিন্তু সেই পথ যতটা মসৃণ বলে অধিকাংশ অভিভাবক ভাবছেন, আদৌ হয়তো ততটা নয়— এমনটাই মত শিক্ষকদের একাংশের।

অবশ্য গোড়াতে আশার আলো দেখিয়ে বাঁকু়ড়া জেলা প্রশাসনের এই কর্মশালায় আগ্রহ দেখাচ্ছেন অনেক তরুণ-তরুণী।

জেলা সর্বশিক্ষা মিশন প্রকল্পের আধিকারিক সুপ্রভাত চট্টোপাধ্যায় বলেন, “শুধু সর্বশিক্ষা মিশন থেকেই একশোর বেশি আবেদনপত্র বিলি হয়ে গিয়েছে। ব্লক দফতরগুলিতেও যাচ্ছেন অনেকে।” তিনি জানিয়েছেন, কর্মশালার মোট আসন সীমিত হওয়ায় এই নাম লেখানোর বন্দোবস্ত করতে হয়েছে।

প্রশাসনের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন অনেক শিক্ষক। প্রশাসনের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাচ্ছে জেলা শিক্ষ মহল। জেলা স্কুলের শিক্ষক বারিদবাবু বলছেন, ‘‘স্কুলে স্কুলে অভিভাবক আর শিক্ষকদের নিয়েও যদি এই ধরনের কর্মশালা হয়, তাহলেই পরিস্থিতিটা গোড়া থেকে পাল্টে দেওয়া যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে আমরাও প্রশাসনকে সব রকমের সাহায্য করতে প্রস্তুত।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Bureaucrats Workshop
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE