Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

দক্ষিণের কড়চা

ও পারে আমাদের ঘর ছিল, জমি ছিল, নদী ছিল। ও পারটা কোন পারে? বাতিল লাইন ধরে পদ্মার দিকে ছুটে যাচ্ছে ক্যামেরা— দোহাই আলি! ও পারে বাংলাদেশ। ছুটে গিয়ে দুয়ার বন্ধ বাফারে আছড়ে পড়ছে আকুতি। ঋত্বিকের ‘কোমল গান্ধার’ থেকে মিহির সেনগুপ্তের ‘বিষাদবৃক্ষ’, দেশভাগ ও উদ্বাস্তু জীবনের যন্ত্রণার ছবি আমাদের চেনা।

শেষ আপডেট: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০০:০১
Share: Save:

পুবের স্বর

আয়না নিঃশ্বাস নেয়

ও পারে আমাদের ঘর ছিল, জমি ছিল, নদী ছিল।

ও পারটা কোন পারে?

বাতিল লাইন ধরে পদ্মার দিকে ছুটে যাচ্ছে ক্যামেরা— দোহাই আলি! ও পারে বাংলাদেশ। ছুটে গিয়ে দুয়ার বন্ধ বাফারে আছড়ে পড়ছে আকুতি। ঋত্বিকের ‘কোমল গান্ধার’ থেকে মিহির সেনগুপ্তের ‘বিষাদবৃক্ষ’, দেশভাগ ও উদ্বাস্তু জীবনের যন্ত্রণার ছবি আমাদের চেনা। কিন্তু ও পার থেকেও কত ট্রেন সীমান্তের দিকে ছুটে এসে বাফারে আছড়ে পড়েছে, তার হিসেব কে রেখেছে?

ভাগের আগে কোথায় ছিল আপনার দেশ? বললেই চেনা উত্তর ছিল— ঢাকা, ফরিদপুর, খুলনা, কুমিল্লা, বরিশাল...। কিন্তু ঢাকার ইসমাইল মতিন যে বলছেন দমদম ক্যান্টনমেন্টের সেই রংচটা সবুজ দরজাটার কথা! আব্দুল হাইয়ের মনে পড়ে যাচ্ছে বারাসতের কদম্বগাছি।

“(কোচবিহারের) দিনহাটা শহরের কেন্দ্রস্থলেই ছিল আমাদের বাড়ি।... আমার প্রথম পাঠ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের “বাল্যশিক্ষা।”... পাখি সব করে রব— রাতি পোহাইলো”— সব মনে পড়ছে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের। দীর্ঘ বর্ণময় জীবনে সেনানায়ক থেকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির পদ সামলে আসা পঁচাশি উত্তীর্ণ মানুষটি গড়গড় করে বলে চলেছেন দিনহাটা হাইস্কুলের একের পর এক শিক্ষকের নাম। বা সেই পায়ওনিয়র ক্লাবের কথা, যাদের ফুটবল দলের সেন্টার ফরোয়ার্ডকে শহরের লোক এরশাদ নয়, চিনত ‘পেয়ারা’ বলে!

শিল্পী বুলবন ওসমান কিছুতেই ভুলতে পারেন না হাওড়ার ঝামটিয়া গ্রামে তাঁর নানার (দাদুর) বাড়ির কথা। “তখনও হাওড়া জেলার কোনও মহকুমা ছিল না। আজ উলুবেড়িয়া মহকুমা।... ঝামটিয়া গ্রামটি আমার কাছে ছিল স্বর্গোদ্যান।” যদিও তাঁর বাবা, সাহিত্যিক শওকত ওসমানের পৈতৃক ভিটে ছিল হুগলি জেলার সবলসিংহপুর গ্রামে। ’৫০-এ সব ছেড়েছুড়ে তাঁরা চট্টগ্রামে চলে যান।

বারাসতের নবপল্লিতে পি কে দে সরকারের কাছে ইংরেজি পড়তে যেতেন মোবারক হোসেন। ’৬৪-র দাঙ্গার সময়ে তা বন্ধ হয়ে যায়। অন্য ছাত্রদের দিয়ে স্যর খবর পাঠান। কিন্তু, মোবারকের বাবা তাঁকে বাড়ির বাইরে যেতে দিতে নারাজ। শেষে এক দিন স্যারই তাঁদের বাড়িতে এসে হাজির। ‘স্যার বাবাকে বললেন, “মোবারকের যদি কিছু হয় আমি আমার বড় ছেলে বাবু-কে দিয়ে দেব।’’ বাবা রাজি হলেন পড়াতে পাঠাতে।’ পরে অবশ্য এ বাংলা ছেড়ে তাঁদের যশোহরে চলে যেতে হয়।

মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক বদরুদ্দীন উমরের ছেড়ে যাওয়া ঠিকানা, বর্ধমান শহরের ২ নম্বর পার্কার্স রোডেই এখন সিপিএমের জেলা সদর র্কাযালয়। তাঁর স্মৃতির পরতে-পরতে হরেকৃষ্ণ কোঙার, বিনয় চৌধুরী, কৃষকসভা। আর নবদ্বীপের গা ঘেঁষা যবগ্রামে মায়াময় ছবির মতো ছড়িয়ে রয়েছে হাসান আজিজুল হকের ‘আমার ছেলেবেলাকার দেশ’।

অটুট ধৈর্যে, অভিনিবেশে ও পারের এই সব বিষণ্ণ-স্মৃতিমেদুর স্বর কুড়িয়ে ছেন রাহুল রায়, তাঁর পশ্চিম থেকে পূর্ববঙ্গ (গাঙচিল) বইয়ে। কিছু সম্পাদকীয় প্রমাদ, যেমন একই লেখায় কোথাও ‘যশোর’ কোথাও ‘যশোহর’ পীড়া দেয়।

বুলবন ওসমান লিখছেন, ‘ও পাশের কেউ মারা গেলে আমরা নীরবে কাঁদি’। পড়তে-পড়তে এক সময়ে কে কোন পাশে আছি, সেই মানচিত্রটাই গুলিয়ে যেতে থাকে। ঈষৎ ভিন্ন প্রেক্ষিতে কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত সেই কবে লিখেছিলেন ‘আয়না যখন নিঃশ্বাস নেয়’। ও পাশ থেকে কখন যেন বাফার পেরিয়ে চলে এসেছে ট্রেন। আয়নাটা নিঃশ্বাস নিতে শুরু করেছে।

বাকুর রামায়ণ

দেবতা জেনে দূরেই দাঁড়িয়ে থাকতে হয় তাঁদের। তাই বন্দনা চলে কাজের মধ্য দিয়ে, কণ্ঠ আর তুলিতে। ওঁরা পদবিতে চিত্রকর, পেশায় পটুয়া। পূর্ব মেদিনীপুরের নানকারচক গ্রামে বাস করে প্রায় দেড়শো পটুয়া পরিবার। তাঁদের মধ্যে অন্যতম পরিচিত বাকু চিত্রকর। সুধীর চিত্রকরের পুত্র এই চিত্রকর সাধারণ পট আঁকার পাশাপাশি দীর্ঘ দিন ধরে করে চলেছেন অভিনব এক কাজ, ‘বর্ণপরিচয রামায়ণ’। প্রায় ২২ ফুট লম্বা, আড়াই ফুট চওড়া পটটি তিনি তৈরি করেছেন ছ’বছর ধরে। বর্ণপরিচয় ধরে স্বরবর্ণ এবং ব্যঞ্জনবর্ণের আদ্যক্ষরে গান বেঁধেছেন রামায়ণ-কাহিনির। রামায়ণের মূল ঘটনাগুলোকে লিখেছেন অ আ ক খ-র ছোট ছোট ছড়ায়। যেমন, ‘আসন পেতে বসে তিনটি রানি, কৌশল্যা, কৈকেয়ী আর সুমিত্রা জননী’ কিংবা ‘গুহক চাঁড়াল তাদের কথা শুনে নৌকামাঝে বসে তাঁদের পৌঁছে দিলেন বনে।’ রাবণের মৃত্যুতেই বাকুর রামায়ণ শেষ। তিনি বলেন, “সীতামাকে যে দুঃখ দিয়েছে তার মরণেই তো শেষ হবে রামায়ণ, আর কীসের দরকার?” এই বর্ণপরিচয় রামায়ণটি বাকু উৎসর্গ করেছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে। আদ্যন্ত চিত্রিত এই বর্ণপরিচয় রামায়ণ সম্প্রতি প্রকাশিত হল টেরাকোটা থেকে, ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায়।

নতুন রূপে

১৯৩২ সালে শুরু হয়েছিল পত্রিকাটি, ‘বিশ্বভারতী নিউজ’। মূলত বিশ্বভারতীর নানা সংবাদ নিয়েই এই পত্রিকা প্রকাশিত হলেও পাশাপাশি ছিল বহু মূল্যবান লেখা, ছবি। স্টেলা ক্রামরিশ এখানেই লিখেছেন গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিল্পকলা সম্পর্কে, বড়দিন সম্পর্কে লিখেছেন সি এফ অ্যান্ড্রুজ। মাঝে দীর্ঘ কাল বন্ধ থাকার পরে সম্প্রতি রবীন্দ্রভবনের উদ্যোগে আবার নতুন করে প্রকাশিত হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী পত্রিকাটি। এখন অবশ্য শুধুই বিশ্বভারতীর সংবাদ পত্রিকাটির বিষয়। পত্রিকাটি যুগ্ম ভাবে সম্পাদনা করছেন তপতী মুখোপাধ্যায় ও অরুণা মুখোপাধ্যায়।

ভুমিপুত্র

পটুয়া কামরুল হাসানকে নতুন প্রজন্ম মনে রাখেনি। বরং অপরাধের সঙ্গে সম্প্রদায়কে মিলিয়ে দেওয়া বা মাদ্রাসা নিয়ে অপপ্রচারে আমাদের সমাজ অভ্যস্ত। সংখ্যালঘু ও দলিতদের এ রকমই নানা বঞ্চনা আর এগিয়ে চলার তাগিদকে ধরার চেষ্টা করেছে ফারুক আহমেদ সম্পাদিত উদার আকাশ পত্রিকার বইমেলা সংখ্যা। সংখ্যার বিশেষ বিষয় ‘ভূমিপুত্রদের জাগরণ’-এ দুই সম্প্রদায়ের লেখকদের আলোচনায় উঠে এসেছে প্রেম, ধর্ম, প্রশাসন থেকে সাঁওতাল বিদ্রোহ। সেলিনা হোসেনের গল্প, আলতামাস কবীর বা শাহীন আখতারের সঙ্গে আলাপচারিতা তুলে ধরেছে অনালোচিত সমস্যা। সেই সঙ্গে সিরাজুল ইসলাম এবং হুমায়ুন কবীরের ব্যক্তিত্ব পরিচিতিও অন্যতম আকর্ষণ।

ঘুড়ির পুণ্যি

মানুষ, ঢাউস, লণ্ঠন, ঘণ্টা। বাক্স, ভড়, ভোমরা, কঙ্কাল। কী মিল? যারা জানে, এক লহমায় বলে দেবে। যারা জানে না, নানা দিক থেকে ভেবেও কি ঠাহর করতে পারবে যে মিল এদের একটাই— আকাশে ওড়ে, লেজ আছে, অথচ পাখি নয়। আসলে ওই সবই নানা কিসিমের ঘুড়ি। ঘুড়ির ইতিহাস-ভূগোল, গল্প-ধাঁধা, তৈরির কায়দা, ছড়া-ছবি নিয়ে পূর্ব মেদিনীপুর থেকে বেরিয়েছে পুণ্যিপুকুর পত্রিকার ঘুড়ি সংখ্যা। বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন তাঁর তড়িৎ আবিষ্কার নিয়ে বেশ কয়েক বার সামনে এসে পড়ে ক্লান্ত করেন ঠিকই। তবে চেনা চালে চলতে-চলতে ছড়া যখন বলে ওঠে— ‘ঘুড়ি মারছে ঘুড়ি মরছে/ ঘুড়ি নিজেরা নিজেরা লড়ছে’, মনে হয় এই বুঝি চকিতে গোঁত্তা মারল চাঁদিয়াল। সম্পাদক ভাস্করব্রত পতি।

মণি-চরিত

‘‘স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস আজও পূর্ণাঙ্গ নয়।” -- মহিষাদলের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নীলমণি হাজরার ডায়েরি ‘স্রোতের ভেলা’র সম্পাদনা করতে গিয়ে অধ্যাপক হরিপদ মাইতির এমন অভিযোগ সঙ্গত বলেই মনে হয়। মাত্র ১২ বছর বয়সে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী মিছিল, পিকেটিং-এ যোগ দেন নীলমণিবাবু। পরে ৪২-এর আন্দোলনে জেলার জাতীয়তাবাদী নেতৃত্ব আসীন হওয়া নীলমণিবাবুর ডায়েরিটিকে ১৯৩০ থেকে ৪০ পর্যন্ত মহিষাদলের রাজনৈতিক পরিস্থিতির গুরুত্বপূর্ণ দলিল বলা যেতে পারে। বঙ্গভঙ্গ ঘোষিত হওয়ার প্রতিক্রিয়া দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় কী রকম হয়েছিল, তার নিদর্শন মেলে নীলমণিবাবুর বাড়ি রাজারামপুরের এমই হাইস্কুলের পড়ুয়া-শিক্ষকদের মিছিলের বর্ণনা থেকে। ডায়েরিতে বীরেন্দ্রনাথ শাসমল, অজয়কুমার মুখোপাধ্যায়, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, সতীসচন্দ্র সামন্তের মতো ব্যক্তিত্বের উল্লেখ রয়েছে পুরো ডায়েরি জুড়েই। পূর্ব মেদিনীপুরের বাকপ্রতিমা থেকে প্রকাশিত ‘স্বাধীনতা সংগ্রামী নীলমণি হাজরার ডায়েরি’ বইটি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গেই সম্পাদনা করা হয়েছে। টীকা অংশটিও সাধারণ পাঠকের জন্য বিশেষ দরকারি।

মানিদা

‘বানার্ড শ ওঁর খুব প্রিয় ছিল। ...অনেকেই রামকিঙ্করকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, উচ্চস্বরে, খুব জোরে জোরে নাটক পড়লে ইংরাজি উচ্চারণে নাকি সড়োগড়ো হওয়া যায়।’ স্মৃতিচারণ করছেন কে জি সুব্রহ্মণ্যন। নব্বইয়ে পৌঁছে শান্তিনিকেতনে সবার প্রিয় ‘মানিদা’র দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়ে প্রকাশিত হল একটি বই, সাক্ষাৎকার (দেবভাষা)। এক অর্থে এ তাঁর আত্মজীবনীও। নিজেকে দেখার সেই দীর্ঘ যাত্রায় এসেছে শৈশবের মাহে শহর, সেখানকার সংস্কৃতি, রাজনৈতিক মতাদর্শের জন্ম, শিল্পীসত্তাকে বোঝা। তার পরে রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন, নন্দলাল, বিনোদবিহারী ও রামকিঙ্করের সোনালি সাহচর্য। আর প্রথম শান্তিনিকেতন যাত্রা, সে বড় মজার। ‘অনেকটা পথ সুটকেসের ওপর বসেই যেতে হয়েছিল। ...ট্রেন কটকে ঢোকার পরে কয়েকজন পুলিশকে কামরায় উঠে আসতে দেখলাম। তারা অন্য যাত্রীদের কাছে আমার নাম বলে জানতে চাইছে এই নামের কোনো যাত্রী কামরায় উঠেছে কি না। আমার কাছে এসেও সেই একই প্রশ্ন করল। জানালাম, আমিই তো সে। তখন ব্যাগপত্তর চেক করে কিছু না পেয়ে চলে গেল।...’ আসলে তারা এসেছিল বিপ্লবী অন্নদাপ্রসাদ রায়চৌধুরীর খোঁজে। এমনই সব মজার ঘটনা আর স্মৃতিচর্চায় নতুন করে এ বইয়ে পাওয়া গেল মানিদাকে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

south karcha southbengal karcha
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE