Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

দক্ষিণের কড়চা

কবি যে শ্রাবণে চলে যাবেন, তা হয়তো নিয়তি-নির্দিষ্টই ছিল। শ্রাবণে, যখন আকাশ বিষণ্ণ, বাতাস ভিজে, অবিরল ভিজতে থাকা বৃক্ষলতাপাতার শরীরে সবুজের নতুন মত্ততা, তার দোলা আর আদিগন্ত মনকেমন— এই তো প্রস্থানের প্রশস্ত সময়।

শেষ আপডেট: ০২ অগস্ট ২০১৫ ০০:১৯
Share: Save:

ছবি ও কবি

কবি যে শ্রাবণে চলে যাবেন, তা হয়তো নিয়তি-নির্দিষ্টই ছিল।

শ্রাবণে, যখন আকাশ বিষণ্ণ, বাতাস ভিজে, অবিরল ভিজতে থাকা বৃক্ষলতাপাতার শরীরে সবুজের নতুন মত্ততা, তার দোলা আর আদিগন্ত মনকেমন— এই তো প্রস্থানের প্রশস্ত সময়।

কবির চেতনে তো দৃশ্যের সঙ্গেই মিশে ছিল সুর, সুরের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল ছবি। যখনই সমর্পণের কথা এসেছে, চকিতে দৃশ্যকল্পে উঠে এসেছে ঝড়-জল। প্রায়শই। আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার....। ১৯১২ সালে ইংরেজি তর্জমায় গীতাঞ্জলি (সং অফারিংস) যখন প্রকাশ পাচ্ছে, তাতে এই গীতটির পাশে সাজিয়ে দেওয়া হচ্ছে নন্দলাল বসুর আঁকা সেই বিরহিনীর ছবিও, যে আকুল হয়ে আঁধার পানে চেয়ে। যে ভাবে ‘বিপুল তরঙ্গ রে’ গানের সঙ্গেও জুড়ে থাকে চিত্রময় নীল তরঙ্গমালা।

কেবলই যে সুরের সঙ্গে দৃশ্য মিলিয়ে দেওয়া, তা তো নয়। কখনও-কখনও দৃশ্য থেকেও উঠে এসেছে গান। রবিতীর্থে বইয়ে অসিতকুমার হালদার যেমন শুনিয়েছেন একটি গল্প— ‘রবিদাদা... আমাকে তাঁর দিব্য প্রজ্ঞা সরস্বতীর চিত্রাভাস তৈরি করতে বললেন৷ তিনি যে ভাবে বর্ণনাকালে জ্যোতিদৃপ্ত ভাব প্রকাশ করেছিলেন তাতে তাঁর সরস্বতীর আভাস পেয়ে একটি অগ্নিময়ী সরস্বতী আঁকলুম৷ রঙিন ছবিটি সম্পূর্ণ করে রবিদাদার সামনে ধরতেই তাঁরও মনে সুরের রঙ ধরলো...।’ এই হল ‘তুমি যে সুরের আগুন লাগিয়ে দিলে মোর প্রাণে’র জন্মকথা, জানাচ্ছেন তিনি।

আবার একটি নাচের দৃশ্য দেখে নন্দলাল এঁকেছিলেন ছবি, রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন গান। অমিতা সেন তাঁর আনন্দ সর্বকাজে বইয়ে শোনাচ্ছেন, ‘১৯২৩-এ রবীন্দ্রনাথ কাথিয়াওয়াড়ে গিয়ে দুই হাতে মন্দিরা বাজিয়ে মেয়েদের নাচ দেখে মুগ্ধ হন৷... আশ্রমের মেয়েদের দেখাবার জন্য রবীন্দ্রনাথ কাথিয়াওয়াড় থেকে দুটি মা এবং মেয়েকে এখানে নিয়ে আসেন৷... ডান হাতের বাঁ হাতের আঙুলে আঙুলে এক এক জোড়া মন্দিরা জড়িয়ে নিয়ে, দুই হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কী সুন্দরভাবে তারা বাজাত৷ মাটিতে বসে দুটি হাত ঘোরাচ্ছে আর মন্দিরা মিষ্টি আওয়াজে বেজে চলেছে, সঙ্গে সঙ্গে মেয়েদের দেহের কী সুন্দর সুষম দোলার ভঙ্গি৷’ কবির মনও দুলে উঠল— দুই হাতে কালের মন্দিরা যে সদাই বাজে! এমনই সব ছবি আর গান নিয়ে সংকলন প্রকাশিত হতে চলেছে প্রতিক্ষণ থেকে, আশিস পাঠকের সম্পাদনায়৷ সঙ্গে নন্দলালের আঁকা সং অফারিংস-এর ছবি, বিপুল তরঙ্গ রে ও মন্দিরা-বাদিকা, হরিশচন্দ্র হালদারের করা ‘বল গোলাপ মোরে বল’-এর চিত্রায়ণ।

সহজ নয়

‘আর কী লুকাবে শ্যাম তোমার কোমল অঙ্গে রতি চিহ্ন’— চন্দ্রাবলীর কুঞ্জে নিশিযাপন করা কৃষ্ণকে বলছেন রাধা-সখী বৃন্দা। শতাধিক বছর আগে যিনি প্রয়াত হয়েছেন, রবীন্দ্রনাথ যাঁর যাত্রা দেখতেন, গান শুনে খুশি হতে শ্রীরামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ নিজে গাইতেন যাঁর গান, অধুনা-বিস্মৃত সেই পালাকার নীলকণ্ঠ মুখোপাধ্যায়ের ‘মান’ পালা ছাপার অক্ষরে তুলে এনেছে হুগলির ত্রিবেণী থেকে প্রকাশিত সহজিয়া পত্রিকা, তার দশম বার্ষিক সংকলনে। লোকায়তের ব্রতকল্পে দশটি বছর পার করে দেওয়া পত্রিকাটির এ বারের পাঠ শুরু হয় গৌরহরি দাসের একটি চিত্তাকর্ষক আলাপচারিতা দিয়ে, যার পরেই আসে তাঁর রচিত পালা ‘বিল্বমঙ্গল-চিন্তামণি’। সাজিয়ে দেওয়া হয় লোকসংস্কৃতি চর্চাকার শেখ মকবুল ইসলামের জীবন, কথা, লেখা। পরম মমতায় আলপনার ভাষা ছেনে চলেন সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, ব্রতর তন্নিষ্ঠ বিবরণ নথিবদ্ধ করে রাখেন বিধান বিশ্বাস। হরকুমার গুপ্তর লেখা পূর্ণাঙ্গ লেটোপালা ‘পচা-পটলা’ সযত্নে তোলা থাকে। সুধীর চক্রবর্তী সযত্নে বাছেন দশটি বাংলা গান, ষেখানে রবীন্দ্রনাথ, লালন শাহ বা দিলীপকুমার রায়ের পাশে অক্লেশে স্থান করে নেন কবীর সুমন এবং মৌসুমী ভৌমিক। ছোট পত্রিকার বিস্তীর্ণ ক্যানভাসে বিষয় বৈচিত্রের অনুপুঙ্খ ধরে রাখেন সন্দীপ দত্ত। সস্তায় বাজিমাতের সহজ পন্থা উপেক্ষা করে সহজিয়া হাঁটে সেই রাস্তায়, যাতে এক পা চলতে গেলেও লাগে দুর্লভ এক বস্তু: নিষ্ঠা।

অনিল স্মরণ

শহরবিমুখ, মফস্সলের আটপৌরে জনজীবনেই দ্রুত বিকেল ফুরিয়ে গিয়েছিল তাঁর। অসময়ে ‘অনন্ত দ্রাঘিমা’য় হারিয়ে যাওয়া অনিল ঘড়াইয়ের খান দুয়েক স্মৃতি নিয়ে খড়্গপুর থেকে প্রকাশিত ‘কিংশুক’ পত্রিকার সদ্য প্রকাশিত সংখ্যাটি। প্রাপ্তি এইটুকুই। না হলে পড়ে থাকে তিনটি সাক্ষাৎকার, যার একটি বাংলাদেশি লেখিকা সেলিনা হোসেনের। আর থাকে ‘দশভুজা’ সহ-সম্পাদকের বিগলিত স্তুতি। পত্রিকার প্রচ্ছদে ঘোষণা ‘হেতুচর্চাই প্রজ্ঞাচর্চার পন্থাবিশেষ’। কিন্তু খড়্গপুর থেকে প্রকাশিত ছোট পত্রিকার প্রথম প্রচ্ছদে ‘বার কোড’ থাকে কী হেতু, তা অজানাই রইল।

শুরুর গল্প

জীবনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই তাঁর প্রথম গল্প সংকলনের নামকরণ, ‘শূন্য থেকে শুরু’। ভূমিকায় নিজেই জানিয়েছেন, ছোট থেকে অণু পত্রিকায় লিখছেন তিনি। তা যে কখন ‘গল্প’ হয়ে উঠেছে বুঝতেই পারেননি। সেই মকশো পর্বের ছায়া এখনও কিঞ্চিৎ রয়ে গিয়েছে পলাশ পাত্রের গল্পে। তবে অযথা নাগরিক জট নেই, বরং আটপৌরে হলেও তরতর করে এগোয় তাঁর ঘটনা-চরিত্রেরা। ‘সোপান পাবলিশার’ থেকে প্রকাশিত বইটির প্রচ্ছদ কিন্তু তেমন চোখ টানে না।

যাত্রাদাস

যে গ্রামে আমি জন্মেছিলাম, প্রশস্ত হলদি নদীর তীরে ষাট-সত্তর বছর আগে সেটির খ্যাতি ছিল গঞ্জ হিসেবে৷ হরিখালি নামটি উচ্চারণ করলেই এখানকার প্রবীণরা মানসনেত্রে দেখতে পাবেন— চব্বিশ ঘণ্টা জমজমাট এক বাণিজ্যক্ষেত্র৷ ... দুর্গাপুজো আর কালীপুজো ছাড়াও আমাদের গ্রাম্য দেবী বাসুলীর শয়াল উৎসবেও যাত্রাগান নিয়মিত অনুষ্ঠিত হত বলে সেই সব দিনগুলিতে আমরা পথের পাঁচালী-র অপুর মতো নিজেদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করে ফেলেছিলাম, জরির মুকুট মাথায়, সেনাপতি সেজে তলোয়ার ঝুলিয়ে যুদ্ধ করব, বড়ো হয়ে যাত্রার দলে যাবই৷’ লিখছেন যিনি, সেই প্রভাতকুমার দাস বড়ো হয়ে যাত্রার দলে যাননি, জীবনটাকে জড়িয়ে রেখেছেন বাংলার যাত্রা নিয়ে গবেষণায়৷ প্রথমে শিক্ষক, তার পরে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশনা আধিকারিক হয়ে অবসর নেওয়া প্রভাতকুমার সম্প্রতি লিখেছেন তাঁর যাত্রা দেখা ও যাত্রা গবেষণার কাহিনি, যাত্রার সঙ্গে বেড়ে ওঠা, বইটি প্রকাশিত হয়েছে কারিগর থেকে৷ এখনও গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন যাত্রার ইতিহাস নিয়ে, তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন যাত্রার পোস্টার, স্টিল নিয়ে একটি দুর্লভ সংগ্রহ৷

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE