Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

দক্ষিণের কড়চা

দল আর দলাদলি নিয়ে ছড়া বাঁধার চল সেই কবেই করে গিয়েছিলেন দাদাঠাকুর। সেই সব মিষ্ট-কষায় স্বাদ বহু দিন বাঙালির জিভে-জিভে ফিরেছে। অন্নদাশঙ্করের ‘তেলের শিশি ভাঙল বলে খুকুর পরে রাগ করো’ তো দেশভাগের বীজমন্ত্র হয়ে গিয়েছে প্রায়।

শেষ আপডেট: ১৬ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:১০
Share: Save:

কালে-কালে

ছড়া-ছড়ি

দল আর দলাদলি নিয়ে ছড়া বাঁধার চল সেই কবেই করে গিয়েছিলেন দাদাঠাকুর। সেই সব মিষ্ট-কষায় স্বাদ বহু দিন বাঙালির জিভে-জিভে ফিরেছে। অন্নদাশঙ্করের ‘তেলের শিশি ভাঙল বলে খুকুর পরে রাগ করো’ তো দেশভাগের বীজমন্ত্র হয়ে গিয়েছে প্রায়।

কিন্তু সে কি ভোটের ছড়া? রাজনীতি মানেই তো ভোট নয়! তা হলে ভোটের ছড়া ঠিক কী? দেওয়ালের চুনে তুলির টানে খেউড়? না কি মুখে-মুখে ফেরা স্লোগানধর্মী পদাবলি? উত্তরটা বোধহয়: দুই-ই। সে শুধু রঙ্গ নয়, ব্যঙ্গও নয়। তাতে ধরা থাকে ইতিহাসের অনুপুঙ্খও। প্রবাদ যেমন, পদ্য যেমন, কিছু ভোটের ছড়াও কাল অতিক্রম করে বাঙালির স্মৃতিতে অক্ষয় হয়ে আছে।

১৯৬৭-তে সিপিআই যখন কংগ্রেসের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে লোকসভা ভোটে এল, সিপিএম দেওয়ালে লিখল, ‘দিল্লি থেকে এল গাই/ সঙ্গে বাছুর সিপিআই।’ সে বার কংগ্রেসের প্রতীক ছিল গাই-বাছুর। জরুরি অবস্থা জারি করার খেসারত দিয়ে ১৯৭৭-এ ধরাশায়ী কংগ্রেস। রায়বরেলীতে হেরে গেলেন ইন্দিরা স্বয়ং। পরের বছর কংগ্রেস (আই) গড়ে তিনি যেই হাত চিহ্ন বেছে নিলেন, বামেরা লিখল, ‘ঝোঁকের মাথায় নিলি হাত, এ বার ভোটে হবি কাত।’

কর্ণাটকের চিকমাগালুর থেকে কিন্তু উপনির্বাচনে জিতে ফিরে এলেন ইন্দিরা। এ বার কংগ্রেসের পাল্টা, ‘রায়বরেলী ভুল করেছে, চিকমাগালুর করেনি সিপিএম জেনে রাখো, ইন্দিরাজি মরেনি।’ প্রধানমন্ত্রী তখন মোরারজি দেশাই, রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। নড়বড়ে জনতা সরকার পড়ে গিয়ে ১৯৮০-র ভোট আসতেই কংগ্রেসের সুপারহিট চিমটি, ‘মোরারজি-জ্যোতি মাতব্বর, পিঁয়াজ-আপেল এক দর।’

নব্বই দশক পর্যন্তও রাস্তায়, দোকানে, স্টেশনে কৌটো নেড়ে চাঁদা তুলত সিপিএম। কংগ্রেসও তাই নিয়ম করে লিখত, ‘দিনের বেলা কৌটো নাড়ে, রাতের বেলায় ফিস্ট/ ভোটের সময় এরাই বলে আমরা কমিউনিস্ট।’ গ্রাম্য কাজিয়াও ছিল। নলহাটির কুরুমগ্রামে কংগ্রেস লিখল ‘(ভোটের তারিখ) আসছে দিন/ জ্যোতি বসুর বিয়ে দিন।’ পরের দিনই পাশের দেওয়ালে ফুটে উঠল ‘লিখেছিস, বেশ করেছিস/ ইন্দিরাকে সাজিয়ে রাখিস।’

১৯৯৮-এর ১ জানুয়ারি জন্মাল তৃণমূল। ২০০১-এর বিধানসভা ভোটে মন্ত্র হয়ে উঠল এক অদৃশ্য ছড়া। দেওয়াল লিখন নয়, মুখে-মুখে ফিরতে লাগল, ‘চুপচাপ ফুলে ছাপ।’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘এ বার নইলে নেভার।’ সে বার কিন্তু হল না। দশ বছর পরে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পার করে রাজ্য যখন পরিবর্তনের ভোটে যাচ্ছে, ছড়া বলল ‘কৃষক মেরে টাটা প্রেম, এরই নাম সিপিএম।’ বাকিটা ইতিহাস।

কিন্তু ইতিহাস মানেই তো চাকার ঘুরপাক। এখন কোথাও দেওয়ালে ফুটে উঠছে, ‘একই বৃন্তে দুটি ফুল, চিটফান্ড আর তৃণমূল।’ কোথাও আবার ‘একি পরিবর্তন আনলে কাকা/ বাজার গিয়ে পকেট ফাঁকা।’ বামেরা দুর্বল বটে। কিন্তু পাঁক থেকে মাথা তুলছে পদ্মফুল। মমতা যতই আওড়ান, ‘কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে তৃণমূল ঘরে ঘরে’, চুপচাপ ফের মুখে-মুখে চলতে শুরু করেছে আর একটি ছড়া বড় গাছের ফল খাও, চারাগাছে জল দাও।

কে জানে, চুন রং করা দেওয়ালের মন আর মুখ এক কি না?

ফেরিওয়ালা

ওঁরা ঘুরছেন। ওঁরা ভোটের চলন্ত সাইনবোর্ড। এক জনের নাম শের আলি। ভোট এলেই তাঁকে একা-একা ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় বর্ধমান শহরের জনবহুল পথঘাটে। বুকে-পিঠে ঝোলানো তৃণমূলের ফ্লেক্স বা পোষ্টার। বাড়ি বাহিরসর্বমঙ্গলা পাড়ায়, বয়স বছর পঁয়তাল্লিশ। পয়লা বৈশাখ বিসি রোডে দাঁড়িয়ে আলি বলেন, “আমি তো নির্দিষ্ট কোনও কাজ করি না। বর্ধমান পুরসভায় তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে সাইকেল স্ট্যান্ডে পাহারা দিয়ে মাঝেমাধ্যে ১০০ টাকা করে পাই। পকেটে টাকা নেই। থাকলে সব জায়গায় প্রচার করতাম।” শ্রীরামপুরে আবার সন্ধ্যে নামতেই মুখোশ পরে ছ’ফুট লম্বা ইলেকট্রনিক বোর্ড কাঁধে রাস্তায় নেমে পড়ছেন মাঝবয়সী লক্ষ্মীনারায়ণ অধিকারী। তাতে জ্বলজ্বল করছে মমতা এবং শ্রীরামপুরের তৃণমূল প্রার্থী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখ। ছকটা মূলত বৈদ্যবাটির পুরপ্রধান অজয়প্রতাপ সিংহের। বোর্ড আনা হয়েছে চিন থেকে। এলইডি আলো দিয়ে যাবতীয় লেখা, প্রতীক এবং ছবি তৈরি করা হয়েছে। ছ’কেজির বোর্ডটি সহজেই স্কুল ব্যাগের মতো বেল্ট দিয়ে পিঠে ঝুলিয়ে দেওয়া যায়। একটু পোক্ত কাঁধ পেলেই হল। রিচার্জেবল ব্যাটারিতে দম থাকে ঘণ্টা ছয়েক। আপাতত সন্ধ্যে নামলে বেরিয়ে পড়ছেন লক্ষ্মীনারায়ণ। পিছন থেকে দেখলে নেতানেত্রী। সামনে থেকে কোনও দিন সান্টাক্লজ, কোনও দিন মিকি মাউস। মুখ দেখার উপায় নেই।

ডিএম লাইভ

শিয়রে ভোট। হাজার কাজে নাওয়া-খাওয়ার সময় নেই পুলিশ-প্রশাসনের কর্তাদের। বাড়তি দায়িত্ব মূলত নতুন প্রজন্ম আর মহিলাদের বুথমুখী করা। সেই কবে থেকে পাড়ায় পাড়ায় প্রচার শুরু করা হয়েছে। বাবা- মায়েদের ভোট দেওয়ানোর জন্য স্কুলপড়ুয়াদের দেওয়া হয়েছে ‘সংকল্পপত্র’। হাটে-বাজারে ইভিএম নিয়ে ‘মক পোলিং’। ভোটের গান বাজছে এখানে-সেখানে। দেখানো হচ্ছে তথ্যচিত্র। টিভিই বা বাদ তাকে কেন? হুগলির জেলাশাসক মনমীত নন্দা ইতিমধ্যেই এক দিন বসে পড়েছেন স্থানীয় কেব্‌ল চ্যানেলের ‘লাইভ ফোন ইন’ অনুষ্ঠানে। আধঘণ্টার অনুষ্ঠানে প্রচুর ফোন এসেছিল। তাতে উত্‌সাহ পেয়ে কাল, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যে সাড়ে ৬টায় চুঁচুড়ায় কেব্‌ল চ্যানেলে ফের বসছেন জেলাশাসক। এক ঘণ্টার অনুষ্ঠানে সঙ্গে থাকবেন পুলিশ সুপার সুনীল চৌধুরীও। ভোট নিয়ে কিছু জানতে চাইলে ফোন করুন, শিগগিরি!

উন্মুক্ত ফাল্গুনী

চণ্ডালিকা, শ্যামা, ডাকঘর, তাসের দেশ-এর মতো রবীন্দ্র-সৃষ্টিগুলির একই ধরনের মঞ্চায়ন দেখে-দেখে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল শান্তিনিকেতন। রবীন্দ্র-সৃষ্টিকে নতুন আঙ্গিকে দর্শকদের সামনে তুলে ধরতে তাই উদ্যোগী হল বিশ্বভারতীর ‘রবীন্দ্র সঙ্গীত গবেষণা কেন্দ্র’। গত শনিবার সন্ধ্যায় নাট্যঘর লাগোয়া প্রাঙ্গনে খোলা আকাশের নীচে অভিনীত হল সঙ্গীত ভবনের নাট্য বিভাগের শিক্ষক অমর্ত্য মুখোপাধ্যায় নির্দেশিত ফাল্গুনী। দর্শকেরা মাঝে বসে, তাঁদের ঘিরে ছ’টি মঞ্চ। যেমনটা হয়ে থাকে ‘ওপেন থিয়েটার’-এ। নাটক দেখে অভিভূত রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন বলেন, “নাটকের নিজস্ব ভাষা এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ভাষা কোনও অন্তরায় হয়নি।” আগামী বছর ফাল্গুনী লেখার শতবর্ষ, সে দিকে লক্ষ্য রেখেই এই প্রয়াস।

বাদলের প্রলাপ

‘এটি একটি দুর্বল নাটক।’ বলেছিলেন নাট্যকার নিজেই। সালটা ১৯৬৭। বাদল সরকারের লেখা প্রলাপ নাটক ‘বহুরূপী’র হয়ে মঞ্চস্থ করার জন্য তাঁকেই আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন শম্ভু মিত্র। কিন্তু নাটক তেমন চলেনি। তখনই বাদলবাবুর ওই মন্তব্য। যদিও পরে নিজের নাট্যদল ‘শতাব্দী’তে নাটকটি এক বার মঞ্চস্থ করেছিলেন তিনি। তৃতীয় বার হল সিউড়ির শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ সভাগৃহে। রবিবার খানিক অন্য মাত্রায় নাটকটি পরিবেশন করল বীরভূমের আনন নাট্যগোষ্ঠী। এই নিয়ে বাদলবাবুর মোট ছ’টি নাটক মঞ্চস্থ করল তারা। প্রতি দু’মাস অন্তর একটি করে। তার মধ্যে ‘এবং ইন্দ্রজিত্‌’ ও ‘সারারাত্তির’ এই দুই নাটকে বাদলবাবু নিজেই কয়েকটি কবিতা লিখেছেন। বাকি চারটি নাটকে প্রয়োজন অনুযায়ী কিছু কবিতা যোগ করেছেন নাট্য পরিচালক বাবুন চক্রবর্তী। প্রলাপ-এ যেমন জীবনানন্দ, জয় গোস্বামী, শামসুর রহমান, রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু কবিতার পঙ্ক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। এই নাটক দিয়েই শেষ হল আননের বাদল উত্‌সব।

চূর্ণীর জন্য

স্কুল ছুটির পরে পড়ন্ত বিকেলে ওরা ঘুরে বেড়াত চূর্ণী নদীর পাড়ে। ওরা মানে রানাঘাট ভারতী হাই স্কুলের জনা কয়েক ছাত্র। “চোখের সামনে নদীটা মরে যাচ্ছে আর আমরা চুপ করে বসে থাকব?” বন্ধুদের উদ্দেশে প্রশ্নটা ছুড়ে দিয়েছিল দ্বাদশ শ্রেণির শুভম ঘোষ। ২০ মার্চ শুভম ও তার বন্ধুরা মিলে ‘চূর্ণী বাঁচাও’ বলে ছবি-সহ একটি ‘মেসেজ’ ফেসবুকে পোস্ট করে। তার পর থেকে তারা আর একা নয়। এই আকালেও চূর্ণী বাঁচাতে সোচ্চার হয়েছেন বহু চেনা-অচেনা মুখ। এখনও পর্যন্ত ৬৫ জন শুভমদের পোস্ট লাইক করেছেন, শেয়ার করেছেন ৬৬৬ জন। শুভম, শুভজিত্‌, তুহিন, রাজ, সায়নরা এখন বলছে, “ফেসবুকের দেওয়ালেই আমরা আটকে থাকব না। এলাকায় ছোট ছোট সচেতনতা সভা করব। সরকারের চোখ টানারও চেষ্টা চলবে।” ছাত্রদের এই চেষ্টাকে স্বাগত জানিয়েছেন নদী বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র। তাঁর কথায়, “উদ্যোগ প্রশংসনীয়। চূর্ণীর অবস্থা সত্যিই খুব খারাপ। চূর্ণীকে বাঁচাতে সকলেরই এগিয়ে আসা উচিত।”

দেশি সম্মানে

তাঁকে সংবর্ধিত করা আর তেলা মাথায় তেল দেওয়া যেন একই ব্যাপার। পদ্মবিভূষণ থেকে দাদাসাহেব ফালকে, এমনকী ফরাসি দেশের সর্বোচ্চ সম্মান লিজিয়ঁ দ্য অনর, কী নেই তাঁর ঝুলিতে? চলচ্চিত্রের জন্য দেশ-বিদেশের অসংখ্য পুরস্কার তো আছেই। তবু বিশ্বভারতীর দেশিকোত্তম পেয়ে খুশি আদুর গোপালকৃষ্ণণ। ‘এটা আমার কাছে অত্যন্ত সম্মানের। ওঁরা যখন পুরস্কারের কথা জানালেন, খুবই আনন্দ পেয়েছিলাম’ তিরুঅনন্তপুরমে নিজের বাড়িতে সদ্য ফিরে এমনটাই বললেন আদুর। ১৯৪১-এ কেরলে জন্ম। পারিবারিক সূত্রেই কথাকলি-সহ নানা শিল্পকলার ঘনিষ্ঠ যোগ। মঞ্চে অভিনয় করেন মাত্র আট বছর বয়সে। ছাত্রাবস্থা থেকেই নাটক লিখে পরিচালনা করতেন। ’৬০-এ কলেজ পাশ করে সরকারি চাকরি নেন। পোষায়নি। দু’বছর পরেই চাকরি ছেড়ে পুণে ফিল্ম ইনস্টিটিউটে যোগ দেন। ছবি করার আগে থেকেই দীর্ঘদিন যুক্ত কেরলের ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলনের সঙ্গে। একাধিক বইও লিখেছেন সিনেমা নিয়ে। আঞ্চলিক ও জাতীয় স্তরে পুরস্কৃত হয়েছে সেগুলি। একাধিক তথ্যচিত্র করেছেন। কাহিনিচিত্রের সংখ্যা ১১। প্রথম ছবি স্বয়ম্বরম মুক্তি পায় ১৯৭২-এ। এর পরে কোডিয়েত্তম, এলিপাত্থায়ম, মুখামুখম, মনন্তরম, মাথিলুকাল, বিধেয়ন, কথাপুরুষণ, নিছালক্কুথু, ফোর উইমেন, আ ক্লাইমেট ফর ক্রাইম। লিজিয়ঁ দ্য অনরের পর দেশিকোত্তম ফের তাঁকে জুড়ে দিল আর একটি নামের সঙ্গে সত্যজিত্‌ রায়। “এতে আমি গর্বিত” বলছেন আদুর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE