Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

দক্ষিণের কড়চা

বছর-বছর পুজোয় চাঁদা ওঠে। চাঁদা না হলে পুজো হবে কী করে? সকলেই কি আর বড়-বড় ব্যানার-হোর্ডিং জোগাড় করতে পারে? না কি, গুচ্ছ বিজ্ঞাপন জোগাড় করে ছাপিয়ে ফেলতে পারে স্যুভেনির? অগত্যা বাড়ি-বাড়ি চাঁদা তোলা ছাড়া গতি কী? কথা হল, কার কোন এলাকা? কে কোথায় চাঁদা তুলবে? পাড়ার সকলে হাত উপুড় করে চাঁদা দেয় না। কিন্তু তা বলে বেপাড়ায় চাঁদা চাইতে যাওয়াটাই বা কেমন? তার হ্যাপাও তো কম নয়!

শেষ আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০১৪ ০১:০৯
Share: Save:

সবার পুজো

নগদে দর্শন

বছর-বছর পুজোয় চাঁদা ওঠে।

চাঁদা না হলে পুজো হবে কী করে? সকলেই কি আর বড়-বড় ব্যানার-হোর্ডিং জোগাড় করতে পারে? না কি, গুচ্ছ বিজ্ঞাপন জোগাড় করে ছাপিয়ে ফেলতে পারে স্যুভেনির?

অগত্যা বাড়ি-বাড়ি চাঁদা তোলা ছাড়া গতি কী? কথা হল, কার কোন এলাকা? কে কোথায় চাঁদা তুলবে? পাড়ার সকলে হাত উপুড় করে চাঁদা দেয় না। কিন্তু তা বলে বেপাড়ায় চাঁদা চাইতে যাওয়াটাই বা কেমন? তার হ্যাপাও তো কম নয়!

তা হলে উপায়?

মুর্শিদাবাদের রঘুনাথগঞ্জে কিশোর বাহিনী ক্লাবের ছেলেরা পণ করেছে, স্পনসর হিসেবে কোনও ব্যবসায়ীর টাকা নেবে না। অথচ আড়াই-তিন লাখ টাকার পুজো পাড়ায় চাঁদা তুলে হয় না। আহা! প্যান্ডেলে যদি টিকিট করা যেত! কিন্তু ‘ওয়ান পাইস ফাদার মাদার’ পাবলিক হয়তো টিকিট কাটতে হবে শুনে আর প্যান্ডেলমুখোই হল না! তা ছাড়া, ‘দুগ্গাপুজোর টিকিট’এটা শুনতেই বা কেমন? এ কি সার্কাস? না ম্যাটিনি শো?

এই সব দোনামোনা করে গত বছরই তারা পুজোর এক দিন মণ্ডপে আসা দর্শনার্থীদের জন্য ২ টাকা করে ‘চাঁদা’ চালু করেছিল। এক দিনেই উঠে যায় ৩৮ হাজার টাকা। এ বার ঠিক হয়েছে, সপ্তমী থেকে দশমী সব দর্শনার্থীদের থেকে ৩ টাকা করে চাঁদা নেওয়া হবে। কিন্তু পাবলিক কি বোকা? চাঁদা বলো বা টিকিট, ঠাকুর দেখতে বেরিয়ে তারা গ্যাঁটগচ্চা দিতে যাবে কেন?

ক্লাবের সম্পাদক কার্তিক হালদার জানান, এই প্রশ্ন তাঁদের সভাতেও উঠেছিল। কিন্তু পাল্টা প্রশ্ন ওঠে যে, পুজোয় যদি সত্যি অভিনবত্ব থাকে, লোকে যদি ধন্য-ধন্য করে, দর্শনার্থীরা কি না দেখে থাকতে পারবেন? সাত বছরের এই পুজো তাই নতুন-নতুন ভাবনা হাজির করছে। গত বছর যেমন ক্লাবের পাশেই পুকুরে ২১টি পুতুল সাজিয়ে তুলে ধরা হয় বানরসেনার সমুদ্রবন্ধন। এ বার কাঠের মঞ্চ সাজিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে পাতালে রক্তবীজ বধ।

অর্থাত্‌ দর্শনার্থীর চাঁদাতেই তাঁদের আমোদের আয়োজন। মাছের তেলেই মাছ ভাজা, তাই না? শহরের বাসিন্দা, সরকারি আইনজীবী অশোক সাহার মতো অনেকেই বলছেন, “মন্দ কী? মোটে ২-৩ টাকা লোকের গায়ে লাগে না। মোটা চাঁদা চেয়ে লোকের বাড়ি জোরজুলুম বা রাজনৈতিক দাদা পাকড়ে স্পনসর জোগাড় করার চেয়ে ঢের ভাল।”

সর্বজনীন পুজো যখন, সর্বজনের বিন্দু যোগ করে সিন্ধু হলে ক্ষতি কী? এটাই চল হয়ে গেলে বরং আজ বাদে কাল চাঁদা তোলার ছাঁদটাই না বদলে যায়!

(সঙ্গের ছবিটি বহরমপুরের একটি মণ্ডপের, কেন্দ্রীয় ভাবনা ‘সুচিত্রা সেন’। ছবি: গৌতম প্রামাণিক।)

বড়োবাবু

‘দূরের থেকে তাকিয়ে দেখলাম দক্ষিণের বারান্দায় বড়োবাবু তাঁর চেয়ারে বসে আছেন, তাঁর সামনে একটি টেবিল পাতা। সেই টেবিলের উপরে ছিল দুই একটি ছোটো ছোটো প্লেট। দূরের থেকে দেখতে পাইনি সেই প্লেটগুলিতে কী আছে। তবে দেখলাম ওই টেবিলের উপরে তিন-চার রকমের পাখি ঠোকর দিয়ে দিয়ে প্লেট থেকে কী সব খাচ্ছে। দেখলাম একটা গাছের থেকে নেমে দুটো কাঠবিড়াল দৌড়ে গিয়ে বড়োবাবুর চেয়ার বেয়ে টেবিলের উপর লাফ দিয়ে উঠছে।’ এই বড়োবাবু, ওরফে দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড়দাদা প্রায় অবহেলিতই ছিলেন। ওই স্বপ্নপ্রয়াণ নামে একটা বইয়ের লেখক, বাক্সমিতি নামে এক বিদ্যার চর্চাকারী, এমন কিছু খণ্ডিত পরিচয়েই তাঁকে দেখা হত। এ বার শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী-র উদ্যোগে একটি পুরোদস্তুর গ্যালারি হল তাঁর জীবন ও কাজ নিয়ে। গ্যালারিতে আছে দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যবহৃত জিনিসপত্র, তাঁর লেখা বই, তাঁকে ঘিরে নানা ছবি ও তথ্যের প্যানেল। গ্যালারির উদ্বোধন করলেন উপাচার্য সুশান্ত দত্তগুপ্ত। রবীন্দ্রনাথের ‘রবীন্দ্রনাথ’নহয়ে ওঠার নেপথ্যের মানুষজনকেও বিশ্বভারতী যথাযোগ্য মর্যাদায় স্মরণ করতে চায়। তাই এই উদ্যোগ, জানালেন বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ।

মেয়েদের আড্ডা

মেলায় যে মেয়েরা বেড়াতে যায়, ছেলেরা কখনও তাদের ওড়না ধরে টানে, কখনও খারাপ ইঙ্গিত করে। আর যে মেয়েরা দোকান দেয়? তাদেরও পুরুষদের হাতে হেনস্থা হওয়ার ভয় থাকে।

তাই যে মেয়ে নিজেরাই পাইকারি হারে খেলনা কিনে মেলায় দোকান দেয়, যে ফুচকা বিক্রি করে, যে বৌমা-শাশুড়ি চপ-ফুলুরির দোকান দিয়েছেন, তাঁরাও স্বামী নইলে ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে দোকান করেন। সামালীর মা মনসা মেলায় মেয়েদের দোকানে দোকানে ঘুরে এমনই তথ্য পেয়েছেন ডলি, জুলি, কমলা, কাকলিরা। এই স্বল্পবিত্ত পরিবারের মেয়েরা দক্ষিণ ২৪ পরগনার ‘জীবিকা’ নামে নারী উন্নয়নের একটি সংস্থার সঙ্গে যুক্ত। প্রায় ২০ বছর সংস্থাটি কাজ চলছে, তবে এ বারই মেয়েরা প্রথম বার করলেন নিজেদের পত্রিকা, ‘সাথী’। প্রথম সংখ্যার বিষয়, ‘মেয়েদের কাজ ও আড্ডা।’ সাবিনা ইয়াসমিন খাতুন লিখছেন, “ ছেলেদের আলাদা ভাবে আড্ডা দেওয়ার সময় ও জায়গা করা থাকে, কিন্তু মেয়েদের সেটা থাকে না। বিশেষ করে বাড়ির বউদের বাড়ির বাইরে আড্ডা দিতে দেখলেই সমাজে নানা কথা শুরু হয়ে যায়।” পত্রিকা বার করে সেই দুঃখটাই ভুলতে চেয়েছেন ওঁরা।

ধাতুশিল্প

দেশ-বিদেশের শিল্পরসিক কে-ই বা আজ ডোকরা শিল্পের কথা জানেন না? ছত্তীসগঢ়ের বস্তারে যেমন, এই রাজ্যের কিছু এলাকাও এই লোকশিল্পের আঁতুড়। কিন্তু শিল্পীদের সাধনা সম্পর্কে আগ্রহ সীমিত।

বাঁকুড়া-বর্ধমানের সেই সব অনালোকিত শিল্পী-জীবন এবং তাঁদের সৃজনের ইতিবৃত্তের খোঁজে দীর্ঘদিন গবেষণা চালিয়ে আসছেন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রহশালার অধ্যক্ষ রঙ্গনকান্তি জানা। সেই গবেষণার ফলাফল নিয়েই সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে ডোকরা আর্ট অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল (রক্তকরবী ও ইনস্টিটিউট অফ হিস্টেরিক্যাল স্টাডিজ)। ইতিহাস তথা লোকসংস্কৃতির গবেষক রঙ্গনবাবু বলেন, “ইংরেজিতে বইটি লেখার উদ্দেশ্য, শিল্পীসমাজ ও তাঁদের জীবনচর্চা সম্পর্কে বৃহত্তর সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। সবার কাছে তাঁদের তথ্য পৌঁছে দেওয়া।”

শিকড়ের সন্ধান

অতীতের বর্ধমান কেমন ছিল? কেমন ছিল সামাজিক জীবন? রাজপরিবারের জীবনযাত্রা? প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই সম্প্রতি বর্ধমান রাজ কলেজের অডিটোরিয়ামে হয়ে গেল আলোচনা। আয়োজক ছিল বর্ধমান ইতিহাস সন্ধান। কেবল তাত্ত্বিক আলোচনার নয়, ছিল গান, আলোচনা। দেবজিত্ বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা গানে বর্ধমানের অবদান নিয়ে বলেন। দাশরথি রায় থেকে কমলাকান্ত, কাজী নজরুল, নীলকণ্ঠ মুখোপাধ্যায়, কে মল্লিক থেকে সুপ্রভা সরকার, সবার কথা বলতে বলতে তিনি গান গেয়েও শোনান। অভীক বিশ্বাস, সঞ্জীব চক্রবর্তী প্রাচীন জনপদ নিয়ে কথা বলেন। অম্বরীশ বন্দ্যোপাধ্যায় বর্ধমানের বৈষ্ণব সাহিত্য নিয়ে বলেন। বক্তারা জানান, একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডকে বুঝতে হলে সেই এলাকার ইতিহাস নিয়ে চর্চা করা প্রয়োজন। কবি অরবিন্দ সরকার এই জেলা নিয়ে প্রচলিত লোককাহিনী লিপিবিদ্ধ করার দাবি জানান। সঞ্চালনা করেন গিরিধারী সরকার।

সুবর্ণচিত্র

ডিভিডি, ডাউনলোড, পাইরেসির ধুমধাড়াক্কায় সিনেমা হল সব উঠে যাওয়ার জোগাড়। কিন্তু স্রেফ মেধা, অনন্যতা, নিষ্ঠা ও ব্যতিক্রমী চর্চার জোরে এখনও পিদিম জ্বালিয়ে রেখেছে বেশ কিছু সিনে সোসাইটি। শুধু বাতি জ্বেলে রাখা নয়, হইহই করে ২৫, ৩০, ৫০ বছর পারও করে দিচ্ছে। মেদিনীপুর ফিল্ম সোসাইটি যেমন এ বছরই উদ্‌যাপন করছে সুবর্ণজয়ন্তী বর্ষ। গত ২৪ ও ২৫ সেপ্টেম্বর ছবি নিয়ে আলোচনা যেমন হল, দেখানো হল স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি এবং তথ্যচিত্রও।

কন্যা এক্সপ্রেস

ভাগাভাগিটা অনেক দিনের। কোনটা ছেলেদের কাজ আর কোনটা মেয়েদের?

ট্যাক্সি ড্রাইভার, মুচি, হকার, ব্ল্যাকার, পঞ্চ ম-কার পুরুষ। রাঁধুনি বা কাজের মাসি, নৃত্যশিল্পী, দেহোপজীবী নারী।

ভাগটা প্রায় আড়াআড়ি। কিন্তু লক্ষ্মণরেখাটা কেউ-কেউ টপকে যান। উদয়শঙ্কর বা বিরজু মহারাজ দিব্যি কিংবদন্তী হয়ে যান নেচে। টিভি থেকে রান্নাঘর আলো করে রাখেন সঞ্জীব কপূর। শক্ত মুঠোয় হাতল ধরে ট্রেন ছুটিয়ে দেন আসানসোলের মৌমিতা অধিকারী।

পাঁশকুড়ার মেয়ে মৌমিতা ছোটবেলায় পাইলট হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। সে আশা পূরণ হয়নি। তাই রেলের পরীক্ষা দিয়ে আসানসোলে চলে যান ট্রেন চালানো শিখতে। বিয়েও করেন এক রেলকর্মীকে। স্বামী ও সাড়ে তিন বছরের সন্তানকে নিয়ে এখন তাঁর সংসার। সেই সংসার তাঁকে বেড়ি পরায়নি।

বাড়ি থেকে স্টেশনে এসেই ব্যাগপত্র গুছিয়ে মৌমিতা উঠে পড়েন ইঞ্জিনে। সোজা চলে যান ইয়ার্ডে। সেখান থেকে ট্রেন বের করে আসেন প্ল্যাটফর্মে। তার পরে ছুট। এর আগে সহকারী চালক হিসেবে কাজ করছিলেন। গত ১৬ জুলাই পদোন্নতি হয়, এ বার পুরোদস্তুর চালক।

ইতিমধ্যে আসানসোল-যশিডি এবং বর্ধমান-গোমো প্যাসেঞ্জার চালিয়েছেন। দ্রুত গতির দূরপাল্লার ট্রেন এখনও চালাননি। তবে তাঁর ইচ্ছে ছুটছে আগে-আগে, অনেক দূরে। “এক্সপ্রেস তো চালাবই, বুলেট ট্রেন চালু হলে, সেটাও চালাব” শান্ত দৃঢ় স্বরে বললেন মেয়ে।

দেবীপক্ষে তিনিই রইলেন নজরের মণি হয়ে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

south karcha southbengal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE