একটি খুনের ঘটনায় অভিযুক্ত সনাক্ত হয়েও অধরা রইল পাঁচ দিন। অন্য একটি খুনের দায়ে শনিবার গ্রেফতার করা হল এমন দুই ব্যক্তিকে, যাঁদের মামলার মূল সাক্ষী ছিলেন নিহত ব্যক্তি।
গত ২২ দিনে দুটি চাঞ্চল্যকর খুন যত না ধাক্কা দিয়েছে জলপাইগুড়িকে, তার চাইতে বেশি উদ্বেগ তৈরি হয়েছে পুলিশের ভূমিকায়। গত সোমবার জলপাইগুড়ি শহরের জনবহুল স্টেশন রোডের পাশে তিনতলা ফ্ল্যাটে ঢুকে আইনজীবী কিশোর চন্দকে খুন করে দুষ্কৃতী। খুনের ঘটনায় মূল অভিযুক্তকেও চিহ্নিত করেছে পুলিশ। যদিও দুষ্কৃতী এখনও অধরা। তার ফলে শহরজুড়ে আতঙ্ক, ক্ষোভ দেখা যাচ্ছে। ‘পুলিশ কী করছে,’ প্রশ্নটা ছড়িয়ে যাচ্ছে মুখে মুখে।
তিন সপ্তাহ ধরে সেই প্রশ্নটা ঘুরছিল নিতাই সিংহের খুনকে কেন্দ্র করে। গত বছর ধূপগুড়িতে সালিশি সভার পর দশম শ্রেণির ছাত্রীকে গণধর্ষণ করে খুনের অভিযোগে রাজ্য জুড়ে চাঞ্চল্য ছড়িয়েছিল। সেই মামলার প্রধান সাক্ষী নিতাই সিংহের দেহ উদ্ধার হয় ধূপগুড়ির একটি ধান খেত থেকে। নিহত ছাত্রীর বাবার নামে অভিযোগ করেন নিতাইবাবুর স্ত্রী। ছাত্রীর বাবা প্রশ্ন তোলেন, তাঁর মেয়ের খুনের প্রধান সাক্ষীকে তিনি কেন হত্যা করবেন?
পুলিশ অবশ্য তিন সপ্তাহ পার করে নিহত ছাত্রীর বাবা আর মামাকেই ধরল। যার পরে প্রশ্ন উঠেছে, কোথাও কি ফাঁক থাকছে তদন্তে? গুরুতর মামলাগুলিতেও পুলিশ কি যথেষ্ট সক্রিয় হচ্ছে? নাকি লোকবল, পরিকাঠামোর অভাবে খুঁড়িয়ে চলছে তদন্ত?
কই পুলিশ? কোনও দিন সকাল থেকে বিকেল গড়িয়ে যায় ভিভিআইপি ‘ডিউটি’তে। কখনও জাতীয় সড়কে যানজটে সামাল দিতেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফুরিয়ে যায়। এ ছাড়াও জেলার স্থানীয় ‘ভিআইপি’দের গতিবিধির উপর নজরদারি তো রয়েইছে। রাজ্যে পরিবর্তনের পরে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা রক্ষীর ব্যবস্থা করতেও আগের থেকে বেশি পুলিশ কর্মীকে নিয়মিত আইনশৃঙ্খলার কাজ থেকে ছেড়ে দিতে রয়েছে।
পুলিশের এক অফিসার উদাহরণ দিয়ে জানান, গত একমাসে জেলায় মন্ত্রী-সহ অন্তত ১১ জন ‘ভিআইপি’ এসেছিলেন। তাঁদের যাত্রাপথে নিরাপত্তা থেকে অনুষ্ঠানস্থলের দায়িত্বও সামল দিতে হয়েছে। ওই অফিসারের কথায়, ‘‘লোকবল যথেষ্ট নেই। তাই সকলকেই সব কাজ করতে হয়। দিনভর ডিউটি করার পরে যে কোনও অফিসারই ক্লান্ত হয়ে যেতে পারে। তদন্তের কাজে সময়ে ভাটা পড়ে।’’
সক্রিয়তার অভাব? পুলিশের একাংশের দাবি, কোনও ঘটনার তদন্তভার মূলত একজন অফিসারের ওপর থাকলেও, ‘টিম’ করে তদন্ত না করলে দ্রুত কিনারা করা সম্ভব হয় না। পুলিশ অফিসারদের মধ্যে সমন্বয় গড়ে তুলতে হয়। কিন্তু তা সম্ভব হচ্ছে না যথেষ্ট পুলিশ না থাকায়।
প্রশ্ন উঠছে তৎপরতা নিয়েও। কিশোর চন্দ হত্যার দিন গভীর রাত থেকে পুলিশ তল্লাশি অভিযান শুরু করে। আইনজীবীদের একাংশের দাবি, পরিচয় জানার পর থেকেই শহর এবং লাগোয়া এলাকায় তল্লাশি চালালে অভিযুক্তকে ধরে ফেলতে পারত পুলিশ।
যদিও জেলা পুলিশ কর্তারা তা মানতে চাননি। জলপাইগুড়ির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জেমস কুজুর বলেন, “পুলিশ বসে নেই। প্রতিটি ঘটনা গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে।”
রাজনৈতিক চাপ? শাসক দলের চাপে তদন্ত থমকে যাচ্ছে, বলছেন বাসিন্দাদের একাংশ। যেমন ধূপগুড়িতে শাসক দলের নির্দেশেই পুলিশ হাত গুটিয়ে বসে রয়েছে বলে অভিযোগ। গত ২ নভেম্বর সকালে ধূপগুড়ি পুরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যপাড়ার ধান খেত থেকে নিতাই সিংহ রায়ের রক্তাক্ত দেহ উদ্ধার হয়। তিনি গত বছর ১ সেপ্টেম্বর রাতে সালিশি সভা থেকে রহস্যজনক ভাবে উধাও মধ্যপাড়ার দশম শ্রেণির ছাত্রী খুনের মামলার প্রধান সাক্ষী ছিলেন।
নিতাইবাবুর পরিবার থেকে নাবালিকার বাবা, মামা সহ পাঁচজন সিপিএম সমর্থকের নামে ধূপগুড়ি থানায় অভিযোগ দায়ের করেন। পুলিশের তরফে দাবি করা হয়েছিল, মূল অভিযুক্তকে চিহ্নিত করা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে তাকে গ্রেফতার করতে সমস্যা কোথায়, তা নিয়েই উঠেছে প্রশ্ন। সেই সঙ্গে প্রশ্ন, নাবালিকাকে খুনের মামলায় অভিযুক্তরা তৃণমূলের কর্মী-সমর্থক বলে, তাদের আড়াল করতেই কি পুলিশ নিষ্ক্রিয়?
যদিও, শাসকদলের হস্তক্ষেপ রয়েছে বলে মানতে চাননি জেলা তৃণমূল সভাপতি সৌরভ চক্রবর্তী। তাঁর দাবি, “পুলিশ নিজেদের মতো তদন্তের কাজ করছে। সেখানে দলের কোন ভূমিকা নেই।”
লাগাতার অপরাধ: শহরে গত ১৭ - ১৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিনটি ছিনতাইয়ের অভিযোগ উঠলেও, একজন দুষ্কৃতীকেও গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। প্রকাশ্যে জনবহুল এলাকায় বাইকে চেপে এসে মহিলার গলার হার ছিনতাইয়ের ঘটনার যেমন অভিযোগ রয়েছে, তেমনিই ভরসন্ধ্যেয় বাড়িতে ঢুকে ছুরি মেরে মহিলার গয়না ছিনতাইয়ের অভিযোগও রয়েছে। শান্তিপাড়া, মোহন্তপাড়া, নিউ সার্কুলার রোড এলাকায় একাধিকবার ছিনতাইয়ের অভিযোগ ওঠায়, স্থায়ী পুলিশি নজরদারির দাবি তুলেছিলেন বাসিন্দারা। তারপরে কয়েকটি মোড়ে সিভিল পুলিশ কর্মীদের নজরদারির দায়িত্ব দেওয়া হয়। তারপরেও বারবার ছিনতাই, বা ছিনতাইয়ের চেষ্টার অভিযোগ উঠেছে। আতঙ্ক এবং ক্ষোভ চলছেই জলপাইগুড়িতে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy