Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
শিলিগুড়ি

গা-জোয়ারি রাস্তা দখল, নিশ্চুপ নেতারা

শিলিগুড়ি শহরের ব্যস্ত রাস্তার দু’ধারের পার্কিং-এর জায়গা দখলের প্রতিযোগিতা চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। কোথাও ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ বোর্ড টাঙিয়ে ‘নো-পার্কিং’ লিখে দিচ্ছেন। আবার কোথাও ‘সাইট ফর ব্যাঙ্ক’ লেখা রয়েছে। কোথাও জুতোর দোকানদার গায়ের জোরে ‘নো-পার্কিং’ বোর্ড দিয়ে রাস্তার ধার কবজা করে রেখেছেন। আবার কোথাও রেস্তোরাঁ মালিক, পান দোকানি, ওষুধ ব্যবসায়ী রাস্তার ধার এমন ভাবে সাইনবোর্ড দিয়ে ঘিরে রাখছেন, যেন তাঁরা পুরসভার থেকে ‘লিজ’ পেয়েছেন।

নো-পার্কিং বোর্ড রয়েছে। তাতে কী? অবাধে পার্কিং হিলকার্ট রোডে। বিশ্বরূপ বসাকের তোলা ছবি।

নো-পার্কিং বোর্ড রয়েছে। তাতে কী? অবাধে পার্কিং হিলকার্ট রোডে। বিশ্বরূপ বসাকের তোলা ছবি।

কিশোর সাহা
শেষ আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০১৪ ০২:৪৬
Share: Save:

শিলিগুড়ি শহরের ব্যস্ত রাস্তার দু’ধারের পার্কিং-এর জায়গা দখলের প্রতিযোগিতা চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। কোথাও ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ বোর্ড টাঙিয়ে ‘নো-পার্কিং’ লিখে দিচ্ছেন। আবার কোথাও ‘সাইট ফর ব্যাঙ্ক’ লেখা রয়েছে। কোথাও জুতোর দোকানদার গায়ের জোরে ‘নো-পার্কিং’ বোর্ড দিয়ে রাস্তার ধার কবজা করে রেখেছেন। আবার কোথাও রেস্তোরাঁ মালিক, পান দোকানি, ওষুধ ব্যবসায়ী রাস্তার ধার এমন ভাবে সাইনবোর্ড দিয়ে ঘিরে রাখছেন, যেন তাঁরা পুরসভার থেকে ‘লিজ’ পেয়েছেন। কাগজে-কলমে পুরসভার থেকে যাঁরা রাস্তার ধারের পার্কিংয়ের টাকা আদায়ের বরাত পেয়েছেন, তাঁদের একাংশের সঙ্গে সব মহলের ‘মাসিক বন্দোবস্ত’ রয়েছে। ফলে, বিধি ভেঙে আমজনতার যানবাহন রাখার জায়গা কবজা করেও পার পেয়ে যাচ্ছেন একশ্রেণির ব্যবসায়ী, পার্কিংয়ের লাইসেন্সপ্রাপ্ত ঠিকাদার বলেও অভিযোগ উঠেছে।

এ সব দেখার কথা পুরসভার-প্রশাসনের। কিন্তু, পুরসভা-প্রশাসন চালান তো রাজনৈতিক দলের নেতারা। বড় মাপের নেতা-কর্তারা প্রায় সকলেই ওই বেআইনি কর্মকাণ্ডের কথা জানেন। বাম-ডান, সকলেই নিশ্চুপ। কংগ্রেস-তৃণমূল কিংবা সিপিএম, এই ব্যাপারে কারও যেন কোনও হেলদোল নেই। কারণ, বাম জমানায় যে ভাবে রাস্তার পার্কিং দখলের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে তা যেন আরও গতি পেয়েছে পুরসভার কংগ্রেস-তৃণমূল জমানায়।

একনজরে দেখে নেওয়া যাক বাম আমলে হিলকার্ট রোডে মেঘদূত সিনেমার গা ঘেঁষে তৈরি হওয়া অনিল বিশ্বাস’ ভবনের আশেপাশের চেহারা। মেঘদূত সিনেমা হলের প্রায় গা ঘেঁষেই ‘অনিল বিশ্বাস ভবন’। সিপিএমের দার্জিলিং জেলার সদর দফতর। ঝাঁ চকচকে বাতানুকূল ভবনটি তৈরিতে ঠিক কত টাকা খরচ হয়েছে তা নিয়ে এখনও অন্তহীন চর্চা হয় শহরে। সেই ভবনের সামনে ‘নো পার্কিং’ বোর্ড টাঙানো থাকে। পুরসভা কিংবা ট্রাফিক পুলিশের দেওয়া হয়। সেই বোর্ডে লেখা ‘বাই অর্ডার ভিএসএম’। অর্থাৎ ‘বিবেকানন্দ সুপার মার্কেট’ কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অনুযায়ী ওই এলাকায় শহরবাসীরা যানবাহন দাঁড় করাতে পারবেন না।

ওই রাস্তা পুরসভার আওতায় রয়েছে। তা হলে বিবেকানন্দ সুপার মার্কেট কর্তৃপক্ষকে কে সেখানে বোর্ড টাঙানোর অনুমতি দিয়েছে? পুরসভার এক কর্তা জানান, এটা পুরোপুরি বেআইনি। কিন্তু, বাম আমলে ওই ভবনেই ছিল সিপিএমের অফিস। ফলে, পুরসভার অনুমতির তোয়াক্কা না করে রাস্তার ধারে পার্কিংয়ের জায়গা দখল করে রাখা হয়েছে বলে পুরসভার কর্মী-অফিসারদের অনেকেই স্বীকার করেছেন। সিপিএম অফিসের সামনেও শহরের নাগরিকদের যানবাহন দাঁড় করানোর অধিকার নেই। সেখানে তো মাঝেমধ্যে দড়ি দিয়ে ঘিরে রাখা হয়ে থাকে। প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্যের নিয়মিত যাতায়াত ওই অফিসে। তা হলে তিনি কেন বেআইনি ভাবে রাস্তা দখল করে রাখা দেখে সরব হন না? প্রাক্তন পুরমন্ত্রীর যুক্তি, “আমাদের দলীয় অফিসে নিজস্ব পার্কিং ব্যবস্থা রয়েছে। আমরা কখনও রাস্তা দখলের পক্ষপাতি নই। এটা কারা করছে জানি না।”

বিবেকানন্দ সুপার মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক শম্ভু প্রসাদ শা স্বীকার করছেন, তাঁরা পুরসভার কোনও অনুমতি নেননি। তাঁর কথায়, “১০ বছর ধরে আমরা রাস্তার দারে নো পার্কিং বোর্ড টাঙিয়ে রেখেছি। পুরসভার অনুমতি নেই। কিন্তু, পুরসভা কখনও আপত্তি করেনি। পুরসভা আপত্তি করলে বোর্ড খুলে দেব।” ওই জায়গায় তো শহরবাসীর যানবাহন রাখার জন্য নির্দিষ্ট। তা হলে শুধু একটি বাণিজ্যিক কেন্দ্রের ব্যবসায়ীরা তা কবজা করে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার খর্ব করতে পারে কি? শম্ভুবাবু বলেন, “শহরবাসী আপত্তি করলে আমরা বোর্ড খুলে দেব। তবে শহরের সব রাস্তায় থাকা সরকারি-বেসরকারি সংস্থার বোর্ডও খুলে দিতে হবে।”

বস্তুত, বোর্ড খোলানোর জন্য পুরসভা নির্দশ জারি করলেই কিন্তু হিলকার্ট রোড, বিধান রোড, সেবক রোডের চেহারা বদলে যেতে পারে। অন্তত ২০০ টি বেআইনি বোর্ড দিয়ে রাস্তা কবজা করে রাখা হয়েছে বলে নিত্যযাত্রীদের অভিযোগ। হিলকার্ট রোডে ‘জগদীশ ভবন’ অর্থাৎ কংগ্রেসের একটি অফিসের সামনে গেলেই দেখা যাবে রাস্তার প্রায় মাঝখানেও যানবাহন দাঁড় করানো রয়েছে। পাশে একাধিক হোটেল কর্তৃপক্ষ জায়গা দখল করে বোর্ড দিয়ে রেখেছেন। ওই হোটেল মালিকদের তরফে কয়েকজনের বক্তব্য, “পুরসভা-প্রশাসন বললেই রাস্তা থেকে আমাদের বোর্ড তুলে নেব।”

পুরসভা সূত্রের খবর, শহরের রাস্তার ধারে পার্কিং ব্যবস্থা যাতে টিকঠাক থাকে সে জন্য ১৬টি সংস্থাকে বরাত দেওয়া হয়েছে। প্রতিদিন শহরে যাতায়াতকারীরা যাতে নির্দিষ্ট ফি দিয়ে যানবাহন রাখতে পারেন সে জন্য বরাত পেয়েছেন তাঁরা। দু চাকার যানের ক্ষেত্রের ন্যূনতম ২ ঘণ্টার ২ টাকা হারে টাকা নেওয়া কথা তাঁদের। বিধি অনুযায়ী, ওই লাইসেন্সপ্রাপ্তরা কখনও ব্যবসায়ী কিংবা কারও কাছে মাসিক ভাড়া নিয়ে পার্তিংয়ের জায়গা পাকাপাকি ভাবে দিতে পারেন না। অথচ বড় রাস্তার অধিকাংশ বিধির তোয়াক্কা না করে বড় গাড়ির ক্ষেত্রে মাসে ২০০ টাকা ও দু-চাকার যানের ক্ষেত্রে মাসে ১০০ টাকা নিয়ে ভাড়া দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ। পার্কিং ফি আদায়কারী সংস্থার কর্মীদের কয়েকজন বলেন, “বড় গাড়ি হলে মাসে ২০০ টাকা দিলে স্থানীয় দোকানদার জন্য নির্দিষ্ট জায়গা ঘিরে রাখা হয়। বাইকের জন্য মাসে ১০০ টাকা নেওয়া হয়। এটা বেআইনি কি না জানি না। তবে মালিকদের সঙ্গে পুরসভার যোগাযোগ রয়েছে বলেই এটা করতে পারছি।”

ঘটনা হল, পুরসভার পার্কিংয়ের বরাতপ্রাপ্ত লাইসেন্সধারীদের একাংশ নানা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। ফলে, বেআইনি কাজের অভিযোগ উঠলেও তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া আদপে সম্ভব কি না সেই প্রশ্ন উঠছে পুরসভার অন্দরেই। শহরের ভুক্তভোগীদের অনেকেরই অভিযোগ, ফি মাসে বেআইনি ভাবে পার্কিং থেকে যে বিপুল অঙ্কের টাকা আদায় হয়, তার একটা বড় অংশ কয়েকজন নেতা-কর্তা পান। সে জন্যই আমজনতার জন্য বরাদ্দ ‘পার্কিং স্পেস’ দখল করেও পার পেয়ে যান একশ্রেণির ব্যবসায়ী। সরকারি অফিস, কয়েকটি ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষও জবরদস্তি রাস্তার পার্কিং বিধি ভেঙে কবজা করে রেখেও জরিমানার মুখে পড়েন না। তা হলে ঘটা করে সদলবলে যিনি মাঝেমধ্যেই শহরের রাস্তায় নেমে সরেজমিনে পরিস্থিতি দেখছেন, সেই উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব কি করছেন সেই প্রশ্ন উঠেছে অনেক মহলেই।

(চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

amar shohor siliguri kishore saha
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE