Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

জমিদার বাড়ির পুজো এখনও অনন্য ঐতিহ্যে

সেই রাজাও নেই, রানিও নেই, নেই রাজ-আমলও। কিন্তু পুজোগুলো রয়ে গেছে আজও। ভক্তি, নিষ্ঠা আর ঐতিহ্যের পরম্পরা আজও অমলিন। জনমানসে তার অনন্যতার আকর্ষণ কমেনি এতটুকুও। উত্তর দিনাজপুরের ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের ধারে প্রায় ৬৫ বিঘা জমির উপরে আনুমানিক ১৩১০-১২ বঙ্গাব্দে তৈরি হয়েছিল ভূপালপুরের জমিদারবাড়ি। ব্রিটিশ সরকার এই বাড়ির একতলাটি নির্মাণ করে দিয়েছিল।

ভূপালপুর রাজবাড়ির পুজো।

ভূপালপুর রাজবাড়ির পুজো।

অনিতা দত্ত
উত্তর দিনাজপুর শেষ আপডেট: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০২:১৯
Share: Save:

সেই রাজাও নেই, রানিও নেই, নেই রাজ-আমলও। কিন্তু পুজোগুলো রয়ে গেছে আজও। ভক্তি, নিষ্ঠা আর ঐতিহ্যের পরম্পরা আজও অমলিন। জনমানসে তার অনন্যতার আকর্ষণ কমেনি এতটুকুও।

উত্তর দিনাজপুরের ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের ধারে প্রায় ৬৫ বিঘা জমির উপরে আনুমানিক ১৩১০-১২ বঙ্গাব্দে তৈরি হয়েছিল ভূপালপুরের জমিদারবাড়ি। ব্রিটিশ সরকার এই বাড়ির একতলাটি নির্মাণ করে দিয়েছিল। তত্‌কালীন আইন অনুযায়ী নাবালক ভূপালচন্দ্রের জমিদারি দেখাশোনার দায়িত্ব ছিল ব্রিটিশ সরকারের। ভূপালচন্দ্রের পিতা কৃষ্ণচন্দ্র রায়চৌধুরী ছিলেন চূড়ামনের জমিদার। কৃষ্ণচন্দ্রের স্ত্রী দুর্গাময়ী চৌধুরানি চূড়ামনে দুর্গোত্‌সবের সূচনা করেন। বাংলা ১৩৩৫ সালে ভূপালপুরে মন্দির প্রতিষ্ঠা হলে পুজো চালু হয় এখানে। পারিবারিক ঐতিহ্য আর পুজোর কাহিনি শোনালেন এই বংশের তৃতীয় পুরুষ পার্থ রায়চৌধুরী। প্রতিমা হয় একচালার। মায়ের গাত্রবর্ণ হলুদ। অসুরের রং সবুজ। চালচিত্রে মহাদেবের উপরে মকরবাহিনী গঙ্গার অধিষ্ঠান। রীতি মেনে আজও সপ্তমীর সকালে নদীতে ঘট ভরতে যাবার সময় বাড়ির পুরুষেরা উপস্থিত থাকেন। এবং জমিদারি ঐতিহ্যের প্রতীক হিসাবে শূন্যে ৫ রাউন্ড গুলি ছুড়ে পুজোর সূচনা হয়। দশমীতে বিরাট মেলা বসে। প্রথা অনুযায়ী মেলা শেষ হলে প্রতিমা নিরঞ্জন হয়।

জলপাইগুড়ির ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে রাজবাড়ির পুজো। ১৫১০-এ সিংহ রাজবাড়ির পুজোর প্রচলন হয়। এখানে পুজো হয় কালিকা পুরাণ মতে। দেবীর গায়ের রং তপ্ত কাঞ্চন। এক সময় বাংলাদেশের নাটোর থেকে আসত দেবীর অলংকার। শাকসব্জি, মহিষ, পাঁঠা, হাঁস, কচ্ছপ, পুজোর নানা উপকরণ আসত বিভিন্ন তালুক থেকে। ইতিহাসে অষ্টমীর গভীর রাতে নরবলির কথাও লেখা আছে। বর্তমানে চালের গুঁড়ো দিয়ে মানুষের প্রতিকৃতি বানিয়ে কুশ দিয়ে বলি দেবার প্রতীকী আয়োজন করা হয়ে থাকে। একে বলা হয় অর্ধরাত্রি পুজো। এ সব তথ্য জানালেন রানি প্রতিভাদেবীর কনিষ্ঠ পুত্র প্রণতকুমার বসু। রাজবাড়ির প্রতিমা নিরঞ্জনটি অভিনব। প্রতিমা রথে বাহিত হয়ে রাজবাড়ির নিজস্ব পুকুরে বিসর্জন দেওয়া হয়। রীতি মেনে পরিবারের সদস্যরা কেউ বিসর্জন দেখেন না।

জলপাইগুড়ি রাজবাড়ির পুজো।

বঙ্গদেশের একমাত্র দেশীয় রাজ্য কোচবিহারে দুর্গাপুজোর প্রবর্তক রাজা বিশ্বসিংহ। জনশ্রুতি, খেলাচ্ছলে এই পুজোর সূচনা করেন তিনি। ৩৪ ফুট উঁচু ৮টি করিন্থিয়াম থাম বিশিষ্ট এই দেবীবাড়িতে বড়দেবীর পুজো মানে কোচবিহারবাসীর কাছে নস্টালজিয়ার টান। রাজোপাখ্যান বলছে, এ পুজোর সূচনাকাল আনুমানিক ১৫১০ খ্রিস্টাব্দে। তবে মূর্তিপুজো নিয়ে বিভিন্ন মত রয়েছে। ৪ ফুট উঁচু কাঠের পাটাতনের ওপর ‘সূপ’কাঠ বসিয়ে প্রতিমা বানানো শুরু হয়। দেবীমূর্তির উচ্চতা ১১ ফুট ৪ ইঞ্চি। দেবীর দু’দিকে বাঘ ও সিংহ রয়েছে। দেবীর সঙ্গে তাঁর পুত্রকন্যারা থাকেন না। থাকেন শুধু জয়া-বিজয়া। অতীতে অন্যত্র প্রতিমা গড়ে ষষ্ঠীর দিন মণ্ডপে স্থাপন করা হত। সে সময় অনুষ্ঠিত হয় ‘টানাটানি’ পুজো। বর্তমানে মূর্তি গড়া হয় মণ্ডপেই। কিন্তু রীতি মেনে আজও ‘টানাটানি’ পুজো হয়ে থাকে। এ পুজোতে শূকর বলিদান করার রীতি রয়েছে। পুজো হয় বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা মতে। অষ্টমীর দিন হয় অষ্টপ্রহর পুজো। প্রতিপদ থেকে মহাষ্টমী প্রতিদিন দেবীকে পরমান্ন ভোগ দেওয়া হয়। অষ্টমীতে হয় ‘চালিয়া বাড়িয়া’ নামক একটি আনুষঙ্গিক পুজোও। অন্নভোগ দেওয়া হয় নবমীর দিন। খিচুড়ির সঙ্গে বোয়াল মাছ রেঁধে নিবেদন করা হয়। দশমীর দিন বিসর্জনের আগে পার্শ্ববর্তী দিঘির ধারে ‘হালুয়া’ পুজো করে শূকর বলি দেবার প্রথা রয়েছে। পুজোর শেষে প্রতিমা খণ্ড খণ্ড করে বিসর্জন দেওয়া হয়। বর্তমানে কোচবিহার দেবোত্তর ট্রাস্টি বোর্ড এই পুজো পরিচালনা করে।

প্রায় সাড়ে তিনশো বছরের পুরানো উত্তর মালদহের চাঁচল মহকুমার মালতীপুর কালীবাড়ির দুর্গাপুজো। পুজোটি প্রচলন করেন চাঁচলের জমিদার। আগে বাসিন্দাদের উদ্যোগে পুজোটি প্রথম শুরু হয় দক্ষিণ শহর নামক এক গ্রামে। পরে স্থানান্তরিত হয় মালতীপুর রাজ এস্টেটের কালীবাড়িতে। পূজিত হয় একচালার প্রতিমা।

অন্নভোগ হয় না। চাঁচল মহকুমার পাহাড়পুরে ও চাঁচলের জমিদারদের প্রতিষ্ঠিত দুর্গাপুজোটি ৩০০ বছর পেরিয়ে গেছে। এখানে পুত্রকন্যা-সহ চতুর্ভুজা মা চণ্ডীর মৃন্ময় মূর্তি পূজিতা হয়। এই দুটি পুজোতেই অষ্টমীর দিন কুমারীপুজো হয়। রীতি মেনে মালতীপুরের প্রতিমা বিসর্জনের দায়িত্ব পালন করেন স্থানীয় আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষেরা আর পাহাড়পুরের যুগি সম্প্রদায়। বিসর্জনের এই প্রথাটি জমিদারি আমল থেকে আজও চালু রয়েছে বলে জানান এস্টেটের পরিচালন সমিতির সুপারভাইজার পিনাকীনাথ ভট্টাচার্য। পাহাড়পুরের বিসর্জনের সময় আরও একটি চমকপ্রদ ঘটনা দেখা যায়। মহানন্দার পশ্চিম পারের মুসলিম সম্প্রদায় প্রতিমা জলে ভাসানোর সঙ্গে সঙ্গে নদীর তীরে লাইন ধরে লন্ঠন জ্বালিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন।

গবেষকদের মতে বাংলার ১৩৩৩ বঙ্গাব্দে ইংরেজি ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে গাজোল থানার পূর্ব রানিপুরে জমিদার মধুসূদন চৌধুরীর শুরু করা দুর্গাপুজো আজও অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে। প্রতিষ্ঠিত দুর্গামন্দিরেই হয়ে আসছে শক্তি আরাধনা। একচালার মূর্তি। অন্নভোগ হয় না। লুচি, ক্ষীর নিবেদন করা হয়। প্রথা মেনে আজও সপ্তমীর সকালে কলাবৌ স্নানের সময় শূন্যে ৪ রাউন্ড গুলি ছোড়া হয়। দশমীতে বিসর্জনের সময়ও একই রীতি পালিত হয় বলে জানান পুজোর দায়িত্বে থাকা ছোট শরিক উদয় চৌধুরী। পূর্ব রানিপুরে দশমীর মেলার আকর্ষণ স্থানীয়দের কাছে আজও জনপ্রিয়।

—নিজস্ব চিত্র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE