Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

ড্যাশবোর্ড খুলেই থরে থরে সোনা, অবাক গোয়েন্দারা

খবর ছিল আগে থেকেই। তাই চলন্ত গাড়িটিকে থামিয়ে আটক করেন তাঁরা। কিন্তু রাতভর তল্লাশি চালিয়েও গাড়িতে সন্দেহজনক কিছুই খুঁজে পাননি ডিরেক্টরেট অব রেভিনিউ ইন্টেলিজেন্স (ডিআরআই)-এর গোয়েন্দারা। শেষে স্থানীয় এক গ্যারাজের মিস্ত্রি ডেকে চারচাকা গাড়িটির ড্যাশবোর্ড আর তার নীচে বিশেষ ভাবে তৈরি চেম্বারটা খোলাতেই চমকে যান সবাই। থরে থরে সাজানো ৪১৪টি সোনার বিস্কুট!

উদ্ধার হওয়া সোনা।—নিজস্ব চিত্র।

উদ্ধার হওয়া সোনা।—নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শিলিগুড়ি ও কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ মার্চ ২০১৫ ০৩:১০
Share: Save:

খবর ছিল আগে থেকেই। তাই চলন্ত গাড়িটিকে থামিয়ে আটক করেন তাঁরা। কিন্তু রাতভর তল্লাশি চালিয়েও গাড়িতে সন্দেহজনক কিছুই খুঁজে পাননি ডিরেক্টরেট অব রেভিনিউ ইন্টেলিজেন্স (ডিআরআই)-এর গোয়েন্দারা। শেষে স্থানীয় এক গ্যারাজের মিস্ত্রি ডেকে চারচাকা গাড়িটির ড্যাশবোর্ড আর তার নীচে বিশেষ ভাবে তৈরি চেম্বারটা খোলাতেই চমকে যান সবাই। থরে থরে সাজানো ৪১৪টি সোনার বিস্কুট!

বৃহস্পতিবার রাতে শিলিগুড়ির এই ঘটনায় মোট ৮৭ কেজি সোনা বাজেয়াপ্ত করেছে ডিআরআই। শুল্ক কর্তাদের দাবি, ১৯৯১ সালের পর থেকে পূর্ব ভারতে একসঙ্গে এতটা বেআইনি সোনা কখনও বাজেয়াপ্ত করা হয়নি। পাচারে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে দুই যুবককেও। শনিবার ধৃতদের শিলিগুড়ি আদালতে হাজির করানো হয়। ধৃত দু’জনকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত জেল হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন অতিরিক্ত মুখ্য বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট (সেকেন্ড কোর্ট) সুপর্ণা দত্ত। আদালত সূত্রে জানা গিয়েছে, ধৃতদের নাম মহম্মদ আব্দুল মতিন এবং গোলাপ হোসেন। আব্দুল মতিন গাড়ির মালিক। তার বাড়ি মণিপুরের থোবালের লিলং এলাকায়। অপর জন চালক। অসমের বরপেটার খন্দকারপাড়ার বাসিন্দা। ধৃতদের কাছ থেকে দু’টি মোবাইল ফোন এবং একটি খোলা সিম কার্ড উদ্ধার হয়েছে।

সোনা পাচারে বেশ ভালই ব্যবস্থা করেছিল তারা। বিলাসবহুল গাড়িটির ড্যাশবোর্ড ও বনেটের নিচের অংশে বিশেষ ভাবে একটা চেম্বার তৈরি করেছিল। তার ভিতরে ১৮টি প্যাকেটে রাখা ছিল সোনা। ৩৭টি বাট, ৩৭৩টি বিস্কুট, ৪টি কাট পিস আকারে ওই সোনা বাদামি প্যাকেটের উপর অ্যাডেসিভ টেপ দিয়ে জড়ানো ছিল। যার আনুমানিক মূল্য প্রায় ২৪ কোটি টাকা, ধারণা কেন্দ্রীয় রাজস্ব গোয়েন্দা বিভাগের আধিকারিকদের।

এ দিন আদালতে কেন্দ্রীয় রাজস্ব বিভাগের আইনজীবী রতন বণিক বলেন, “দেশের মধ্যে এই প্রথম এত বিপুল পরিমাণ সোনা উদ্ধার হল। সুইৎজারল্যান্ড, আমেরিকা থেকে ওই সোনা আনা হয়েছে। এর সঙ্গে আন্তর্জাতিক সোনা পাচার চক্র জড়িত বলেই সন্দেহ করা হচ্ছে।” গোয়েন্দা কর্তারা জানাচ্ছেন, ওই সোনা মায়ানমার থেকে বেআইনি ভাবে উত্তর-পূর্ব ভারতে এসেছিল। সেখান থেকে পাচার করা হচ্ছিল কলকাতায়।

শুল্ক দফতর সূত্রের খবর, সম্প্রতি মায়ানমার সীমান্ত দিয়ে এ দেশে বেআইনি সোনা ঢুকছে বলে খবর মিলেছিল। তার পর থেকেই অসম, মণিপুর-সহ উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে খোঁজখবর নিচ্ছিলেন ডিআরআই অফিসারেরা। সেই সূত্রেই খবর মেলে, দিন কয়েক আগে মণিপুরের মায়ানমার সীমান্ত দিয়ে প্রচুর সোনা এ দেশে ঢুকেছে।

শুল্ক দফতরের অফিসারেরা জানাচ্ছেন, মণিপুর দিয়ে ঢোকা ওই সোনার হদিস করতে কাজে লাগানো হয় কয়েক জন গোয়েন্দা অফিসারকে। তাঁরা খবর পান, অসমের এক ব্যক্তি চার চাকার ‘সেডান’ গাড়ি নিয়ে শিলিগুড়ির দিকে যাচ্ছেন। তাঁর সঙ্গে রয়েছেন মণিপুরের এক যুবক। গাড়ির নম্বরও নির্দিষ্ট ভাবে জানতে পেরেছিলেন গোয়েন্দারা। সেই খবর মতোই বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ শিলিগুড়ির কাছে একটি জায়গায় ওই চার চাকা গাড়িটিকে আটকান ডিআরআই অফিসারেরা। আব্দুল ও গোলাপকে আটক করে শুরু হয় জিজ্ঞাসাবাদ। শুল্ক দফতরের এক কর্তার কথায়, “গাড়ি তল্লাশি করেও কিছু মিলছিল না। কিন্তু ওই গাড়ি ও যুবকদের সম্পর্কে আমাদের কাছে নিশ্চিত তথ্য থাকায় ওদের ছেড়ে দিইনি।”

শুল্ক দফতরের একটি সূত্র জানাচ্ছে, পাচার চক্রে আরও অনেকে জড়িত। তাদের খোঁজে তদন্ত শুরু হয়েছে। শুল্ক দফতরের একাংশ বলছেন, চোরাপথে আমদানি করা আরও সোনা উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে রয়ে গিয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। তা নিয়েও খোঁজ করছেন গোয়েন্দারা। তাঁরা আরও জানাচ্ছেন, সম্প্রতি পূর্ব ভারতের নানা জায়গায় বেআইনি সোনা পাচারের ঘটনা বাড়ছে। প্রতি সপ্তাহেই একাধিক বার বিমানবন্দর থেকে বেআইনি সোনা-সহ পাচারকারীদের ধরা হচ্ছে। গত দু’বছরে কলকাতার শুল্ক গোয়েন্দা দফতর প্রায় ৫০০ কেজি সোনা বাজেয়াপ্ত করেছে।

হঠাৎ সোনা পাচারের ঘটনা এত বেড়ে গিয়েছে কেন? শুল্ক দফতরের কর্তাদের একাংশের ব্যাখ্যা, বছর দেড়েক আগে কেন্দ্রীয় সরকার সোনা আমদানির উপর শুল্ক বাড়িয়েছে। তার ফলে বিদেশ থেকে সোনা আমদানির খরচ বেড়েছে। সেই থেকেই বেড়ে গিয়েছে চোরাপথে সোনা পাচার।

আরও একটি কারণ দেখিয়েছেন গোয়েন্দারা। তাঁরা বলছেন, সম্প্রতি আন্তর্জাতিক বাজারে সোনার দাম বেশ কিছুটা কমেছে। কিন্তু এ দেশের বাজারে সেই হারে কমেনি। তার ফলে বিদেশ থেকে চোরাপথে বিরাট পরিমাণে সোনা আমদানি করলে এক দিকে যেমন অনেক কর ফাঁকি দেওয়া যাবে, তেমনই দেশের বাজারে বেচলে লাভও হবে। এই বিষয়টিই চোরাকারবারিদের প্রলুব্ধ করছে। “মায়ানমার সীমান্ত দিয়ে এক বারে এতটা সোনা ঢোকানোর পিছনেও এই কারণ রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে,” মন্তব্য এক শুল্ককর্তার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE