গ্রেটার মামলার রায় জানার পর আদালত থেকে বেরিয়ে আসছেন বংশীবদন বর্মন। ছবি: হিমাংশুরঞ্জন দেব।
এক আইপিএস অফিসার-সহ তিন পুলিশকর্মীর হত্যার মামলায় বেকসুর খালাস পেলেন ‘গ্রেটার কোচবিহার পিপলস অ্যাসোসিয়েশন’ (জিসিপিএ)-এর সম্পাদক বংশীবদন বর্মন-সহ ৪৩ জন। ২০০৫-এ পৃথক কোচবিহার রাজ্যের দাবিতে আন্দোলন চলাকালীন জিসিপিএ-র কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে সংঘর্ষে ওই তিন জন মারা যান বলে অভিযোগ। যদিও শুক্রবার কোচবিহার জেলা ও দায়রা আদালতের বিচারক রবীন্দ্রনাথ সামন্ত রায় দেন, অভিযোগের পক্ষে পর্যাপ্ত তথ্য-প্রমাণ পেশ করতে পারেনি পুলিশ। ফলে, বংশীবদনবাবুদের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ টেঁকেনি।
বাম জমানায় শাসক দলের মদতে পুলিশ মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে বংশীবদনদের জেলে পুরে রেখেছে বলে বারবারই অভিযোগ করতেন বিরোধীরা। ২০১১-য় তৃণমূল রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পরে, ওই বছরেই জামিন পান বংশীবদনেরা। এ দিন সে সূত্র মনে করিয়ে দিয়ে তৃণমূলের কোচবিহার জেলা সভাপতি রবীন্দ্রনাথ ঘোষ বলেন, “বাম সরকার অমানবিক ভাবে ওই ৪৩ জনকে জেলে পুরে রেখেছিল। তাঁরা মুক্তি পাওয়ায় আমরা খুশি।” প্রায় একই সুর বিজেপি-র জেলা সম্পাদক নিখিল দে এবং জেলা কংগ্রেস সভাপতি শ্যামল চৌধুরীর গলাতেও।
জবাবে রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী তথা সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য অনন্ত রায় বলেন, “পুলিশের সঙ্গে গোলমাল হয়েছিল। প্রশাসন মামলা করেছিল। ঘটনার সঙ্গে বামফ্রন্ট সরকারের যোগ নেই।” তবে জেলা বামফ্রন্টেরই আর এক নেতা তথা ফরওয়ার্ড ব্লকের জেলা সম্পাদক উদয়ন গুহ বলেন, ‘‘বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন ছিল ওটা। বামেদের দোষ ধরতে আজ যাঁরা আনন্দ প্রকাশ করছেন, কাল তাঁরাও টের পেতে পারেন বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন কী চরম চেহারা নিতে পারে!’’
ঘটনাচক্রে, বেকসুর খালাস হয়েই এ দিন বংশীবদনও ঘোষণা করেছেন, ‘‘তৃণমূল সরকারকে ধন্যবাদ। না হলে জেলেই বছরের পর বছর কাটাতে হতো। এ দিনের রায়ে নতুন করে উদ্যম পেয়েছি আমরা। আলাদা কোচবিহারের দাবিতে নতুন করে আন্দোলন শুরু করা হবে।”
১৯৯৮ সালে আলাদা কোচবিহার রাজ্যের দাবিতে গড়ে ওঠে ‘জিসিপিএ’। তাদের দাবি, ভারতভুক্তি চুক্তি অনুসারে কোচবিহারের কেন্দ্রশাসিত ‘গ’ শ্রেণির রাজ্য হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা হয়নি। সেই সূত্রে আলাদা রাজ্যের দাবিতে আন্দোলনে অনড় ছিল তারা। ২০০৫-এর ২০ সেপ্টেম্বর ‘গ্রেটার কোচবিহার’ রাজ্যের দাবিতে ‘জিসিপিএ’-র আন্দোলনকে ঘিরে তেতে ওঠে কোচবিহার। শহরের উপকণ্ঠে প্রায় ৩০ হাজার সমর্থক অনশনে বসেন। লাঠি চালিয়ে, কাঁদানে গ্যাসের শেল ফাটিয়েও তাঁদের হঠাতে ব্যর্থ হয় পুলিশ। শেষ পর্যন্ত পুলিশ গুলি চালালে দুই আন্দোলনকারী—চিত্ত রায় এবং বিশাদু বর্মন মারা যান। এর পরেই গৌরচন্দ্র ধর ও যোগেশচন্দ্র সরকার নামে দুই কনস্টেবলকে জনতা পিটিয়ে মারে। জনতার মারে জখম হয়ে পরে হাসপাতালে মারা যান অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (কালিম্পং) মুস্তাক আহমেদ।
দুই কনস্টেবল হত্যায় একটি এবং মুস্তাক আহমেদকে খুনের অভিযোগে আর একটি মামলা রুজু হয়। দু’টি মামলাতেই বংশীবদন-সহ ‘জিসিপিএ’-র মোট ৪৭ জন অভিযুক্ত ছিলেন। ঘটনার পাঁচ দিন পরে বংশীবদন আত্মসমর্পণ করেন। মামলা চলাকালীন চার জন মারা যান। অভিযুক্তের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৩।
জিসিপিএ নেতা-কর্মীদের পক্ষে আইনজীবী শিবেন রায় বলেন, “দীর্ঘদিন ধরেই বলছিলাম, রাজনৈতিক কারণে বাম আমলে পুলিশ-প্রশাসনের কর্তারা বংশীবদনবাবু-সহ অন্যদের মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়েছেন।’’ তাঁর দাবি, তদন্তের নামে ‘প্রহসন করে’ নিরীহ লোকদের ধরা হয়। অভিযোগের পক্ষে তাই প্রমাণ দেখাতে পারেনি পুলিশ। এমনকী, শুনানি-পর্বে পুলিশের তরফে করা দাবিও আদালতে প্রমাণ করা সম্ভব হয়নি। ৪০ পাতার রায়ে বিচারক জানিয়েছেন, যাঁদের বিরুদ্ধে ওই খুনের অভিযোগ আনা হয়েছে, তাঁরা যে ওই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত তা সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণ করতে ব্যর্থ সরকার পক্ষ।
জেলার পুলিশ সুপার রাজেশ যাদব এ দিন ফোন ধরেননি। এসএমএসেরও জবাব আসেনি। তবে জেলা পুলিশের এক কর্তা দাবি করেছেন, সাধ্যমতো তথ্য-প্রমাণ জমা দিয়েছে পুলিশ। মামলার সরকারি আইনজীবী পীযূষ দাস বলেন, “এই রায়ের বিরুদ্ধে কলকাতা হাইকোর্টে আবেদন জানানোর জন্য রাজ্যকে লিখব। সরকার সিদ্ধান্ত নেবে।”
ওই রায় ঘোষণার পরে রীতিমতো উচ্ছ্বাসে মাতেন জিসিপিএ-র কর্মী-সমর্থকেরা। আদালত চত্বর থেকে মিছিল করে তাঁরা কোচবিহার সদরের সাগরদিঘি চত্বর পরিক্রমা করেন। মিছিলের পুরোভাগে ছিলেন বংশীবদন। সম্প্রতি তেলঙ্গানা পৃথক রাজ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পরে তিনি বলেছিলেন, ‘‘তেলঙ্গানা যদি আলাদা রাজ্য হয়, কোচবিহার কেন হবে না?’’ এ দিন ফের সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেছেন, ‘‘আলাদা রাজ্যের দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে অনেক মানুষ জেলে পচেছেন। অনেকের সংসার ভেঙে গিয়েছে, জেলে থাকাকালীন মারাও গিয়েছেন চার জন। ওই ক্ষতির মাসুল কে দেবন? তাই কোচবিহার রাজ্যের দাবিতে আন্দোলন জারি রাখব আমরা।”
তবে আদালতের রায়ে বিষণ্ণ নিহত পুলিশ-কর্তা মুস্তাক আহমেদের পরিবার। তাঁর ছেলে ইশতিয়াকের প্রশ্ন, ‘‘সহকর্মীকে পিটিয়ে মারা হলেও প্রমাণ জোগাড় করতে পারে না পুলিশ! এর পরে সাধারণ মানুষ পুলিশে বিশ্বাস রাখবে কী করে!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy