Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

প্যাকিং বাক্সে বন্দি কালী ফিরে এলেন কালিম্পঙেই

উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা কালী মন্দির গুলির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ইতিহাস আর জনশ্রুতির আশ্চর্য মিশেল। সময় এগিয়ে গেছে, কিন্তু মন্দিরগুলি ঘিরে মানুষের ভয় আর ভক্তির ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়েনি কোনও। সর্বত্রই কালীপুজোয় বিশেষ আরাধনার প্রস্তুতি চলছে পুরোদমে।

চারণকবি মুকুন্দ দাস প্রতিষ্ঠিত শিলিগুড়ির আনন্দময়ী কালীবাড়ির পুজো।—নিজস্ব চিত্র।

চারণকবি মুকুন্দ দাস প্রতিষ্ঠিত শিলিগুড়ির আনন্দময়ী কালীবাড়ির পুজো।—নিজস্ব চিত্র।

অনিতা দত্ত
শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ২২ অক্টোবর ২০১৪ ০২:১৩
Share: Save:

উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা কালী মন্দির গুলির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ইতিহাস আর জনশ্রুতির আশ্চর্য মিশেল। সময় এগিয়ে গেছে, কিন্তু মন্দিরগুলি ঘিরে মানুষের ভয় আর ভক্তির ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়েনি কোনও। সর্বত্রই কালীপুজোয় বিশেষ আরাধনার প্রস্তুতি চলছে পুরোদমে।

উত্তরবঙ্গের পর্যটন মানচিত্রেও স্থান করে নিয়েছে কালিম্পঙের অষ্টমাইল এলাকার কালীমন্দিরটি। বর্তমানে ঢাকায় কমলা কালীবাড়ি যে-জমিদারির অংশ, সেই জমিদারের সেজ ছেলে স্বামী জ্ঞানানন্দ তীর্থনাথ এই মন্দিরটির প্রতিষ্ঠাতা। দেশভাগের আগেই কালিম্পঙে এসেছিলেন তিনি। প্রায় ৪ ফুট উচ্চতার কষ্টিপাথরের কালী মূর্তিটি তিনি এনেছিলেন জয়পুর থেকে। ভারত-চিন যুদ্ধে অস্থিরতার কারণে কালিম্পঙে মূর্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয় বুঝে, বীরভূমের সুরুলে মূর্তিটি স্থাপন করতে উদ্যোগী হন তিনি। জনশ্রুতি সেখানে নাকি কিছুতেই মূর্তি সমেত প্যাকিং বাক্সটি খোলা যায়নি। অগত্যা তিনি কালিম্পঙেই ফিরিয়ে নিয়ে আসেন মূর্তিটি। প্রথমে মন্দিরটি ছিল কাঠের তৈরি ও দ্বিতল। বর্তমানে পাহাড়ের গায়ে হেলান দেওয়া পাকা মন্দির প্রাঙ্গণে রয়েছে অতিথি নিবাসও। দীপান্বিতা কালীপুজোর রাতে সোনা ও রুপোর অলংকারে সাজিয়ে তোলা হয় প্রতিমা। কালিম্পঙের স্থানীয় লেপচা, ভুটিয়া, ও নেপালি জনগোষ্ঠীর মানুষরাও পুজোতে শামিল হন বলে জানান মন্দিরের ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক বিশ্বনাথ চক্রবর্তী।

শিলিগুড়ি শহর থেকে ছুট লাগালেই সেবক পাহাড়। এখানকার সব আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু সেবকেশ্বরী কালীমন্দিরও সেজে উঠছে দীপান্বিতার আলোয়। মন্দিরসংলগ্ন পাহাড়ি পথের ধারে ফুলমালা-প্রসাদের দোকানগুলিতে সারা বছরই ভিড় লেগে থাকে। উত্তরবঙ্গের মানুষের কাছে আলাদা আকর্ষণ এই কালীমন্দিরের। নিসর্গের মাঝে এই কালী মন্দির পর্যটকদেরও আকর্শন করে বছরভর।

শিলিগুড়ি থানার কাছেই কালীবাড়ি রোডে চারণকবি মুকুন্দ দাস প্রতিষ্ঠিত আনন্দময়ী কালীবাড়ি। এই মন্দিরের গায়েও লেপ্টে আছে একটি চমকপ্রদ ইতিহাস। এখন যেখানে পাকা মন্দির, সেখানে আগে ছিল টিনের চালাঘর। তথ্য অনুযায়ী সালটা ছিল ১৯১৫। জনৈক চন্দ্রমোহন চক্রবর্তী মৃন্ময়ী মূর্তির নিত্যপুজো করতেন এখানে। পাশেই ছিল স্বদেশীদের শরীরচর্চার আখড়া। ১৯২৩-২৪ সাল নাগাদ মুকুন্দদাস এই চালা ঘরেই সাত রাত ধরে গান গেয়েছিলেন। শর্ত ছিল, পালাপিছু ৫১ টাকার মধ্যে ৫০ টাকা মন্দির নির্মাণের কাজে দান করবেন। ভক্তদের সংগৃহীত অর্থে পাকা মন্দিরটি গড়ে উঠল ১৯২৬ সালে। কবি মুকুন্দ দাসই কালীবাড়িটির নামকরণ করেন। সেই সময়ে ৫০১ টাকা মূল্যের কষ্টিপাথরের মূর্তিটি নিয়ে আসা হয়েছিল বেনারস থেকে। প্রতি বছর কালীপুজোর দিন এলাকার প্রায় পাঁচ হাজার মানুষের মধ্যে প্রসাদ বিতরণ করা হয়।

জলপাইগুড়ি শহরসংলগ্ন এলাকা পান্ডাপাড়ায় রয়েছে দেবী ভদ্রকালীর মন্দির। কথিত আছে, বৈকুণ্ঠপুরের রাজা দর্পদেব (রাজত্বকাল ১৭৫৮-৯৩) এই পুজো শুরু করেন। অন্য মতে, কোচবিহারের রাজা রূপনারায়ণ এ পুজোর প্রচলন করেন ১৬৯৩ সাল নাগাদ। মন্দিরের মৃন্ময়ী মূর্তিটি একটি নাগ ও নাগিনীর লেজের ওপর প্রতিষ্ঠিত। দেবীর দু’হাতে ধরা সাপ দুটি। এ মূর্তির সঙ্গে পরিচিত কালীমূর্তির কোনও মিল নেই। এখানে প্রতিমার জিহ্বা অদৃশ্য। ঠোঁটের পাশ বেয়ে নেমেছে রক্তের ধারা। মূর্তির এক পাশে ডাকিনী ও অন্য পাশে যোগিনী দণ্ডায়মান। ড. চারুচন্দ্র সান্যালের মতে ‘ইনি চণ্ডীরূপী মনসা, মহাদেবের সঙ্গে সাক্ষাতের পূর্বে রণরঙ্গিনী ধ্বংসকারিণী মূর্তি।’ দীপান্বিতা কালীপুজোর রাতে প্রচুর মানুষের সমাগম হয় এই মন্দিরেও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE