গত দুর্গাপুজোর ঘটনা। শিলিগুড়ির আশ্রমপাড়ার প্রবীণা পর্ণা চট্টোপাধ্যায়ের ছেলে-মেয়ে দিল্লিতে থাকেন। পর্ণাদেবী একাই থাকেন শহরে। পর্যটন দফতরের পুজো প্যাকেজ দেখে, নবমীর দিন প্রায় হাজার টাকা দিয়ে বুকিং-ও করেন। জলপাইগুড়ির তিস্তা পর্যটক আবাসে প্যাকেজ শুরুর সময় দেখেন, ঘোরার জন্য রাখা হয়েছে পুরনো একটি স্কুল বাস। নড়বড়ে সিটে বসে দিনভর কী ভাবে ঘুরবেন, ভেবে চিন্তিত হয়ে পড়েন। একই প্রশ্ন তোলেন প্যাকেজে ঘুরতে আসা আরও বয়স্ক সহযাত্রীরাও। কোনও মতে টাকার কথা ভেবে সে বার ঘুরলেও সরকারি প্যাকেজে আর কোনও দিন যাবেন না জানিয়ে দেন, পর্ণাদেবী। প্রাতঃরাশে এক বোতল জলের সঙ্গে ঠান্ডা কাটলেট, নরম নরম ফিঙ্গার চিপসের বিশ্রি স্বাদের কথা ভুলতে পারেননি ৫৫ বছর বয়সী ওই মহিলা।
সম্প্রতি শিলিগুড়ি থেকে সরকারি প্যাকেজে দার্জিলিং ঘোরার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন, শিবমন্দিরের বাসিন্দা শ্রীমন্ত দে। জংশনে খোঁজখবর করতে গিয়ে দেখেন, সরকারি ভাল বাসে দার্জিলিং ঘোরা তো যাবে, কিন্তু প্যাকেজের পুরো খাবারের খরচ নিজেকেই বহন করতে হবে। আর বিভিন্ন পরিষেবা কর-সহ সরকারি লজ বা অতিথি নিবাসে খাবারের খরচ ৩ দিনে যা পড়বে, তাতে বাইরে থেকে চাইলে অনেক সস্তায় খাবার মিলবে। দু’জন ছাড়া আবার প্যাকেজ বুকিং মিলবে না। সব কিছু ভেবে পিছিয়ে যান শ্রীমন্তবাবু। আবার জলদাপাড়া, গরুমারা, বক্সা মিলিয়ে প্যাকেজ থাকলেও তিন দিনে ঘড়ি ধরে করা প্যাকেজটি কতটা চলবে তা নিয়ে প্রশ্ন ছিল, পর্যটন দফতরের অফিসারেরা একাংশের মনে। দফতর সূত্রের খবর, তাই গত ছ’মাসে কখনও একাধিক পুজো প্যাকেজ, কখনও জঙ্গল-পাহাড় প্যাকেজ চালু করলেও আশানুরূপ সাফল্য পাচ্ছে না রাজ্য পযর্টন উন্নয়ন নিগম কতৃর্পক্ষ।
সরকারি সূত্রের খবর, প্রতি ক্ষেত্রেই প্যাকেজের সূচি, কর্মীদের ব্যবহার থেকে পরিষেবা, পরিকাঠামো মতো নানা বিষয় নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তাই আপাতত কালিম্পং, সিকিম বা ভুটান ট্যুর প্যাকেজ চালুর চিন্তাভাবনা করলেও পযর্টনের সঙ্গে জড়িত বিশেষজ্ঞ, সংগঠনগুলির মতামত নিয়ে এগোতে চাইছেন না নিগম কতৃর্পক্ষ। আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি শিলিগুড়িতে বৈঠকের দিনক্ষণ ঠিক হয়েছে। পযর্টন উন্নয়ন নিগমের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর চিন্না মুরুগণ-সহ শীর্ষ অফিসারেরা উপস্থিত থাকবেন বলে ঠিক হয়েছে।
নিগমের এমডি চিন্না মুরুগণ বলেন, ‘‘কলকাতা, দক্ষিণবঙ্গের পাশাপাশি উত্তরবঙ্গের কিছু প্যাকেজ ট্যুর চালু করা হয়েছে। কিন্তু তাতে ঠিকঠাক সাড়া মিলছে না। দু’টি আধুনিক বাসও পাঠানো হয়েছে। তার পরেও এই অবস্থা কেন তা আমরা বুঝতে চাইছি। তাই পর্যটনে জড়িত বিশেষজ্ঞ, সংগঠন-সহ বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। তাতে নিশ্চয়ই নানা দিক উঠে আসবে। ভবিষ্যতে সেগুলিকে মাথায় রেখে এগোনো হবে।’’
পযর্টনের সঙ্গে জড়িতদের বিশেষজ্ঞদের কথায়, ‘‘সরকারি অতিথি নিবাস, সাফারির কথা বলা হলেও রাজ্য পযর্টন দফতরের প্যাকেজগুলির কম জনপ্রিয়তার প্রথম এবং অন্যতম কারণ, ন্যূনতম পরিষেবার খামতি।’’ অভিযোগ যাত্রার শুরু থেকে শেষ অবধি সরকারি কর্মীরা যে পরিষেবা দেন, বেসরকারি ক্ষেত্রের তুলনায় তা কিছুই নয়। নিয়মিত খোঁজখবর রাখা, খাবারের মান, থাকার ঘর, গাড়ি, ব্যবহার সব দিকে যেন একটা দায়সারা ব্যাপার থাকে। আবার ঘড়ি ধরে ঘোরার কথা থাকলেও বেসরকারি ক্ষেত্রে শিথিলতা রাখা হয়। এখানে তা হয় না। তাই একবার কেউ এই সব প্যাকেজে গেলে আর সাধারণত যেতে চান না।
আবার সরকারি স্তরে এই ধরনের প্যাকেজ চালু হলেও তা আদতে বেসরকারি সংস্থাগুলির সঙ্গে প্রতিযোগিতার সামিল হয়ে দাঁড়ায। সেখানে কমিশনের বিষয় না থাকায় বেসরকারি সংস্থাগুলি এই প্যাকেজের মাধ্যমে পর্যটকের পাঠাতে উৎসাহ দেখান না। আবার নিজেরা প্যাকেজ চালু করলেও তাতে যে ধরনের আগ্রাসী মার্কেটিং করার দরকার হয়, তা সরকারি স্তরে কখনওই হয় না। লোকে ঠিকঠাক জানতেই পারেন না।
প্যাসিফিক এশিয়া ট্রাভেল অ্যাসোসিয়েশনের (পাটা) ইন্ডাস্ট্রি কাউন্সিল সদস্য সম্রাট সান্যালের কথায়, ‘‘প্রথম তো সঠিক পরিষেবা। সেই সঙ্গে বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে যৌথ ভাবে এই ধরনের সরকারি প্যাকেজ চালাতে হবে। তাতে প্যাকেজগুলি জনপ্রিয় হবেই। এটা সরকারি অফিসারদের বুঝতে হবে।’’
আবার অ্যাসোসিয়েশন ফর কনজারভেশন অ্যান্ড ট্যুরিজমের আহ্বায়ক রাজ বসু বলেন, ‘‘সরকার পরিকাঠামো, সরকারি সাহায্য, প্রশিক্ষণ দেবে এবং নজরদারি করবে। আর পযর্টন বিকাশ হবে বেসরকারি সংস্থাগুলিকে নিয়েই। আমাদের পাশের রাজ্য সিকিমে তাই হয়, অথচ এখানে হয় না। তাই জঙ্গল, পাহাড় ঘোরা নিয়ে নানা কিছু বললেও সরকারি প্যাকেজ চলে না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy