Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
কুলতলির জের

পাহাড়-ডুয়ার্সে পর্যটন কেন্দ্রে আরও নিরাপত্তা দাবি

সুন্দরবনের কুলতলিতে পর্যটকদের ঘরে ডাকাতির খবরে উদ্বেগ ছড়িয়েছে পাহাড় ও ডুয়ার্সের পর্যটন মহলেও। পাহাড়-জঙ্গল ঘেরা নির্জন ডুয়ার্সে পর্যটকদের ওপর দুষ্কৃতীদের হামলা আশঙ্কাও অমূলক নয়। তাই পর্যটনের স্বার্থে বাড়তি নিরাপত্তাও দাবি করছেন ট্যুর অপারেটর সহ পর্যটন ব্যবসায়ীরা।

নিজস্ব প্রতিবেদন
জয়ন্তী শেষ আপডেট: ৩১ মার্চ ২০১৫ ০৩:৩২
Share: Save:

সুন্দরবনের কুলতলিতে পর্যটকদের ঘরে ডাকাতির খবরে উদ্বেগ ছড়িয়েছে পাহাড় ও ডুয়ার্সের পর্যটন মহলেও। পাহাড়-জঙ্গল ঘেরা নির্জন ডুয়ার্সে পর্যটকদের ওপর দুষ্কৃতীদের হামলা আশঙ্কাও অমূলক নয়। তাই পর্যটনের স্বার্থে বাড়তি নিরাপত্তাও দাবি করছেন ট্যুর অপারেটর সহ পর্যটন ব্যবসায়ীরা। কয়েক বছর আগে জয়ন্তীতে জঙ্গলের পথে গাড়ি থামিয়ে পর্যটকদের মারধর করে সর্বস্ব ছিনতাই করেছিল দুষ্কৃতীরা। ওই ঘটনায় কেউ ধরা পড়েনি। ২০০৮ সালে চাপড়মারিতে পর্যটকদের কার-সাফারির সময়ে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। ২০১০ সালে মিরিকেও একটি বেসরকারি হোটেলে হামলা চালিয়ে পর্যটকদের মারধর করে ক্যামেরা, ল্যাপটপ মোবাইল নিয়ে পালিয়েছিল। পরে মূল পাণ্ডকে অবশ্য পুলিশ গ্রেফতার করে।

ইস্টার্ন হিমালয়ান ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশনের কার্যকরী সভাপতি সম্রাট সান্যাল জানান, আগে চিলাপতা, জয়ন্তী, বক্সায় ডাকাতি, ছিনতাই হত। কিন্তু দক্ষিণবঙ্গের তুলনায় উত্তরবঙ্গে পর্যটন ব্যবসার সঙ্গে স্থানীয় বাসিন্দারা ওতপ্রোত ভাবে যুক্ত। অনেকে সরাসরি যুক্ত। ফলে, তাঁরাই নজরদারি চালানোয় দুষ্কৃতী হামলা তেমন হয় না। তিনি বলেন, ‘‘তবে অপেক্ষাকৃত নতুন ও নির্জন পর্যটন কেন্দ্রে বাড়তি নিরাপত্তা দরকার।” ডুয়ার্সের ট্যুর অপারেটর অরিন্দম দে-র কথায়, “শিলিগুড়ি মালবাজার লাটাগুড়ির রাস্তায় অনেকটা অংশই নির্জন চা বাগান আর জঙ্গলে ঘেরা। অতীতে গাড়ি থামিয়ে ছিনতাই অনেক ঘটেছে। পুলিশকে এখন থেকেই বাড়তি ভূমিকা নিতে হবে।”

আরেক ট্যুর অপারেটর সন্তু চৌধুরী জানালেন, সুন্দরবনের ঘটনার পরে ডুয়ার্সে যাতে সেই আতঙ্কের রেশ না পড়ে, সে জন্যে প্রশাসনকেই উদ্যোগী হতে হবে। লাটাগুড়ি রিসর্ট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক দিব্যেন্দু দেবের কথায়, “লাটাগুড়ি এমনিতে শান্তিপূর্ণ। তবে পর্যটকদের নিরাপত্তা বাড়ানো দরকার।” দার্জিলিং অ্যাসোসিয়েশন অব ট্যুর এজেন্টসের সাধারণ সম্পাদক প্রদীপ লামা জানান, “তিন দশকের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি এমন পর্যটক হেনস্থার ঘটনা পাহাড়ে কখনও হয়নি। বরং পাহাড়ে পর্যটকেরা অনেক শান্তিতে থাকেন।’’ দার্জিলিঙের পুলিশ সুপার অখিলেশ চতুর্বেদী বলেন, “পাহাড়ে পর্যটক হয়রানির অভিযোগ ইদানীংকালে কোথাও নেই। তবে পুলিশের তরফে পর্যটকদের হয়রানি রুখতে সারা বছরই তত্‌পরতা চলে।”

বছর চারেক আগে রাজাভাতখাওয়া-জয়ন্তীর মাঝে পর্যটকদের গাড়ি থামিয়ে লুটপাট হয়। মারধর করা হয় পর্যটকদের। ঘটনার পর বেশ কয়েক বছর কেটে গেলেও দুষ্কৃতীরা কিন্তু ধরা পড়েনি। চিলাপাতা থেকে জয়ন্তী, রায়মাটাং সর্বত্রই একই অভিযোগ। চিলাপাতা এলাকায় একের পর এক টুরিস্ট লজ তৈরি হয়েছে। এলাকার লজ ব্যবসায়ী গণেশ শা বলেন, “সারা বছরই পর্যটকদের আনাগোনা রয়েছে। তবে এলাকায় পুলিশ টহলের কোনও ব্যবস্থা নেই।” জয়ন্তীর ট্যুরিস্ট গাইড সংস্থার সম্পাদক শেখর ভট্টাচার্যের কথায়, বছর চারেক আগে রাজাভাতখাওয়ায় কাছে বক্সা জঙ্গলে পর্যটকদের গাড়ি ছিনতাই আটকে ছিনতাই করে দুষ্কৃতীরা। তারপরেও পরিস্থিতি পাল্টায়নি। এলাকায় পুলিশি টহলের কোন ব্যবস্থা নেই। কিছু হলে প্রায় ২৫ কিমি দূরে কালচিনি থানায় খবর দেওয়ার পরে পুলিশ পৌঁছয়। রাজাভাতখাওয়ার পর্যটন ব্যবসায়ী নিতু ভট্টাচার্য বলেন, “বছর পাঁচেক আগে রাজাভাত খাওয়ার পুলিশ ফাঁড়ি ছিল। কিছু হলে তারা সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলে পৌঁছত। পুনরায় ওই ফাঁড়ি চালুর দাবি রয়েছে।” আলিপুরদুয়ার জেলার পুলিশ সুপার আকাশ মেঘারিয়া বলেন, “পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য বিভিন্ন এলাকায় পুলিশের মোবাইল ভ্যান টহল দেয়। তা ছাড়া স্থানীয় থানার নম্বর বিভিন্ন এলাকায় দেওয়া রয়েছে।”

আলিপুরদুয়ার জেলা ট্যুর অপারেটার অ্যাসোসিয়েশেনর সম্পাদক তমাল গোস্বামীর কথায়, ‘হোম স্টে এবং কটেজগুলির নিরাপত্তা জোরদার করা জরুরি। পুলিশ ও প্রশাসনের কর্তাদের কাছে কটেজ এবং হোম স্টে স্টেশনগুলি রেজিস্ট্রেশনের আবেদন জানাব। সেটা হলে নিরাপত্তা অনেকটাই বাড়বে।

মালদহের গৌড়, গাজলের আদিনা ও হবিবপুরের জগজীবনপুরে রাতে থাকার ব্যবস্থা নেই। কিন্তু দিনেও পর্যটন কেন্দ্রগুলিতে পুলিশি নজরদারি সে ভাবে নেই। ওই সব এলাকার আশেপাশে পিকনিকের আসর বসে। মালদহ টুরিস্ট লজের ম্যানেজার উমেশ সিংহ বলেন, “জেলায় টুরিস্ট অফিসার নেই। নিরাপত্তারও ব্যবস্থা নেই। পর্যটকদের উপর তেমন কোনও হামলার ঘটনা এই জেলাতে ঘটেনি ঠিকই। তবে পর্যটন কেন্দ্রগুলিতে নিরাপত্তার প্রয়োজন রয়েছে।”

কোচবিহার সদরের রসমতি পর্যটন কেন্দ্র, খোল্টা ইকো পার্ক, তুফানগঞ্জের রসিকবিল মিনি জু, দিনহাটার গোসানিমারি পর্যটন কেন্দ্র ছাড়াও মাথাভাঙার তেকুনিয়ায় ফি মাসে পর্যটকদের ভিড় উপচে পড়ে। কিন্তু ওই সব পর্যটন কেন্দ্রের বেশির ভাগ এলাকার নিরাপত্তা বন্দোবস্ত ঢিলেঢালা বলে অভিযোগ। ওই সব পর্যটন কেন্দ্রের মধ্যে কোথাও চাঁদার জুলুমের, কোথাও আবার সন্ধ্যের পরে মদ, জুয়ার ঠেক চলছে। দু-একটি জায়গায় পুলিশ ক্যাম্প থাকলেও হাতে গোনা কয়েকজন পুলিশ কর্মী দায়িত্বে আছেন। রাজবাড়ি, মদনমোহন বাড়ি, সাগরদিঘি, লাগোয়া বাণেশ্বর, মধুপুর এলাকাতেও পর্যটকরা ভিড় জমান। সন্ধ্যার পরে সাগরদিঘি চত্বরের আনাচে-কানাচেও মদের আসর বসছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।

রাজ্যের বনমন্ত্রী বিনয় বর্মন বলেন, “কুলতলির ঘটনা বিচ্ছিন্ন ব্যাপার। বন দফতর ও পুলিশ সর্বত্র সমন্বয় রক্ষা করে কাজ করছে। কোচবিহারেও ওই যোগাযোগ রয়েছে। পর্যটকদের নিরাপত্তার কোনও সমস্যা হবে না।” কোচবিহারের পুলিশ সুপার রাজেশ যাদব জানান, রসিকবিল, গোসানিমারিতে পুলিশ ক্যাম্প রয়েছে রাজবাড়ি, মদনমোহন মন্দির, বাণেশ্বরেও পুলিশ পাহারা রাখা হয়েছে। তার পরেও যে সব এলাকায় ওই ব্যবস্থা নেই, সেখানে পুলিশের মোবাইল ভ্যানে নজরদারি চালান হয়। উদ্বেগের কোনও ব্যাপারই নেই।

পর্যটক ও বাসিন্দাদের অনেকেই অবশ্য তাতে আশ্বস্ত নন। কোচবিহার থেকে প্রায় ২০ কিমি দূরের রসমতি পর্যটন কেন্দ্রে সারা বছর বিভিন্ন এলাকা থেকে পর্যটকরা যান। চলতি বছরেরই ১ জানুয়ারি ওই পর্যটন কেন্দ্রে গিয়েছিলেন একটি কোচিং সেন্টারের পড়ুয়ারা। আচমকা বাইক নিয়ে ঢুকে পড়ে একদল যুবক সেখানে ছাত্রীদের উত্যক্ত করে বলে অভিযোগ। আতঙ্কিত পড়ুয়ারা বাড়ির দিকে রওনা হলে রাস্তা আটকে গাড়ির চালককে মারধর করে ছাত্রীদের শ্লীলতাহানি করা হয় বলেও কোচবিহার কোতোয়ালি থানায় অভিযোগ করা হয়েছিল। অভিযুক্তদের একজনকে পুলিশ গ্রেফতারও করে। কিন্তু আতঙ্ক কাটেনি। বেশির ভাগ সময় ওয়াচ টাওয়ার লাগোয়া বিশাল বনাঞ্চলে মাত্র দু’জন বনরক্ষী পাহারার দায়িত্বে থাকেন। রাজ্যের প্রাক্তন বনমন্ত্রী অনন্ত রায় বলেন, “আগে বনরক্ষী পর্যাপ্ত ছিল। এখন রসমতি থেকে রসিকবিল, খোল্টা কোথাও বেড়ানর পরিবেশ নেই। নিরাপত্তা বলে কোথাও কিছু নেই।”

রাজ্য পর্যটন দফতরের উত্তরবঙ্গের যুগ্ম অধিকর্তা সুনীল অগ্রবাল বলেন, ‘‘পর্যটন কেন্দ্রগুলির নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে যা পরিকল্পনা নেওয়ার সেটা কলকাতা থেকে হবে।’’ জলপাইগুড়ি জেলা পুলিশ সুপার আভারু রবীন্দ্রনাথন জানান, জেলার পর্যটন কেন্দ্রগুলিতে নজরদারি ছিলই সুন্দরবনের ঘটনার পরে পেট্রোলিং বাড়ানো হয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE