গিরিধারী গন।—নিজস্ব চিত্র।
পাহাড়ি ঢাল বরাবর লাইন ধরে নেমে আসছিল টয় ট্রেনটি। সোমবার প্রজাতন্ত্র দিবসের ছুটির দিনে ট্রেনের কামরা থেকে ভেসে আসছিল যাত্রীদের হাসির শব্দ, গানের সুরের ছন্দে হাততালিও।
কার্শিয়াঙের চুনাভাটির ঢালে ট্রেন পৌঁছতেই ছবিটা বদলে যায়। হুড়হুড়িয়ে নামতে শুরু করে ট্রেনটি। দাঁড়াতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়েন যাত্রীরা। পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা খেয়ে লুটিয়ে পড়ে মারা যান এক মহিলা মলি পাল (৫১)। তখনই পিছনের কামরা থেকে দৌড়ে এসে ট্রেনের জরুরি ব্রেকটি ঘুরিয়ে দেন শিলিগুড়ির বাসিন্দা গিরিধারী গণ। থেমে যায় ট্রেনটি। প্রাণে বাঁচেন অন্যান্য যাত্রীরা।
যাত্রীরা জানাচ্ছেন, চুনাভাটি ঢাসে পাহাড়ি ঢালে দুলকি গতির পরিবর্তে ট্রেনটি হুড়হুড় করে নামতে শুরু করে। কাঁপতে শুরু করে কামরার জানলা-দরজা। ট্রেনটির স্বাভাবিক গতি ঘণ্টায় ১৫ থেকে ১৬ কিলোমিটার হওয়ার কথা। সেখানে ট্রেনটির গতি অন্তত তিন গুণ বেড়ে যায়। ট্রেনের পিছন কামরার যাত্রীরা তখন গানের লড়াই খেলছিলেন। গানের সুর বদলে যায় আতঙ্কে চিত্কারে। মুখোমুখি সিটে বসে থাকা যাত্রীরা হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন অন্যের গায়ে। দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই হুমড়ি খেয়ে পড়েন অনেকে। যাত্রীদের দাবি, স্থানীয় বাসিন্দারাও সে সময়ে ‘ব্রেক ফেল’ করেছে বলে চিত্কার করতে শুরু করেন। ততক্ষণে আতঙ্কিত হয়ে চলন্ত ট্রেন থেকে লাফিয়ে নেমে পড়েন কয়েকজন যাত্রী। লাফ দিয়ে পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা খেয়ে লুটিয়ে পড়েন মলিদেবী। ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু হয়। পিছনের কামরায় থাকা এক রেলকর্মীও লাফিয়ে পড়েন। ইঞ্জিনে থাকা এক সহকারী চালকও বিপদ বুঝে লাফিয়ে নেমে পড়েন। সে সময় পেছন কামরায় থাকা শিলিগুড়ির এক বাসিন্দা দৌড়ে গিয়ে জরুরি ব্রেক ঘুরিয়ে দেওয়ায় ট্রেনটি থামে। তাতেই বড় দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পান যাত্রীরা। তাঁদের দাবি, অন্তত ৮ মিনিট ট্রেনের কোনও নিয়ন্ত্রণ ছিল না।
শিলিগুড়ির বাসিন্দা একটি চা বিপণন সংস্থার কর্মী প্রশান্ত বসু বলেন, “ছুটির দিন চড়ুইভাতির মেজাজে টয় ট্রেনে চেপেই সকলে মিলে আনন্দ করব ভেবেছিলাম। শিলিগুড়ি থেকে তিনধরিয়া পর্যন্ত ভালভাবেই কাটল। ফেরার সময় হঠাত্ই বুঝতে পারি, অস্বাভাবিক গতিতে ট্রেনটা নামতে শুরু করেছে। ট্রেনের যে কর্মী আমাদের কামরায় ছিল, তাঁকে চিত্কার করে চলন্ত ট্রেন থেকে লাফিয়ে নেমে যেতে দেখে শিউরে উঠি। ট্রেনের একপাশে খাদ। চোখের সামনে যেন মৃত্যুর হাতছানি দিতে দেখলাম।”
শিলিগুড়ির হাকিমপাড়ার বাসিন্দা চিকিত্সক নিকিতা সাহা ওই ট্রেনে ছিলেন। তিনি জানান, ট্রেনের গতি বেড়ে যাওয়ায় জানলা দিয়ে উঁকি মারতেই দেখেন ইঞ্জিন থেকে একজন লাফিয়ে নামছেন। তাঁর কথায়, “কামরার সকলে মিলে কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছে। হঠাত্ই ট্রেনটি থেমে যায়। পরে জেনেছি, এক যাত্রী জরুরি ব্রেক ঘুরিয়ে ট্রেন থামিয়েছেন। তাঁর জন্যই প্রাণে বাঁচতে পেরেছি। ওঁর ছবিও মোবাইলে তুলে রেখেছি।”
নিকিতা দেবীর মতো যাত্রীদের অনেকেরই ধন্যবাদ পেয়েছেন শিলিগুড়ির পূর্ব বিবেকানন্দ পল্লির বাসিন্দা গিরিধারী গণ।
বন্ধুদের পরিবার নিয়ে মোট ২৩ জনের দল তৈরি করে টয় ট্রেনে সোমবারের জঙ্গল রাইডে উঠেছিলেন বই ব্যবসায়ী গিরিধারীবাবু। সহযাত্রীদের দাবি, ট্রেনের কামরায় যখন হুলুস্থুল কান্নাকাটি চলছে সে সময় পেছন দিকে দৌড়ে যান তিনি। কামরার শেষ প্রান্তে থাকা লোহার হাতল দু’হাতে ধরে ঘোরাতে শুরু করেন। গিরিধারীবাবু বলেন, “সকলের মতো আমিও প্রথমে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। হঠাত্ই জরুরি ব্রেক দেখে দৌড়ে যাই। পরে অনেকে জানতে চেয়েছে আমি রেলের কর্মী কিনা। আসলে ছোট বেলা থেকেই টয় ট্রেনে চড়ছি। কামরার শেষ প্রান্তে থাকা লোহার হাতলটি যে জরুরি ব্রেক, তা জানতাম।” গিরিধারীবাবুর সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী সোমাদেবী এবং তাঁদের মেয়ে সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী ঈশিতা। সোমাদেবী বলেন, “সোমবার রাতে বাড়ি ফিরে আমরা কিছু খেতেও পারেনি। মাঝরাতে উঠেও ভয়ে মেয়ে কেঁদেছে।”
ট্রেন থামার পরেও দুর্ভোগ পিছু ছাড়ে নি যাত্রীদের। দুপুরে দুর্ঘটনাটি ঘটলেও বিকেল পর্যন্ত উদ্ধারকারী দল পৌঁছয়নি বলে অভিযোগ। ট্রেনের আরেক যাত্রী রূপালি ঘোষ বলেন, “খাদের পাশ দিয়ে ট্রেন চলাচল করে, নিরাপত্তার এমন অবস্থা, ভাবতে পারিনি। বিপদের সময়ে ট্রেনের কর্মীদেরও দেখা মেলেনি।” রূপালিদেবীর প্রশ্ন “কার হাতে এতজন যাত্রীর ভার দিয়ে রেল কর্তৃপক্ষ ট্রেন চালায় তা বুঝলাম না।”
রেলের তরফে অবশ্য ব্রেক কাজ না করা অথবা নিয়ন্ত্রণ হারানোর কথা অস্বীকার করা হয়েছে। সোমবারের দুর্ঘটনার কারণ খতিয়ে দেখতে মঙ্গলবার নিউ জলপাইগুড়িতে বৈঠকে বসে রেলের তদন্তকারী দল। ট্রেনে বড়সড় কোনও বিভ্রাট না হলেও আতঙ্কের কারণেই বিপত্তি হয়েছে বলে দাবি করে নিউ জলপাইগুড়ির সিনিয়র এরিয়া ম্যানেজার পার্থ শীল বলেন, “তদন্ত হচ্ছে। সব বিষয় খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy