এই পরিবেশেই চলে মাছ বেচা-কেনা। নিজস্ব চিত্র।
মাছের বাজারে ঢুকতে গিয়ে কাদায় পা পিছলে পড়ে যাচ্ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত নার্স প্রতিমা দেব। ভাগ্য ভাল যে তিনি নিজেকে সামলে নিয়েছিলেন। খুচরো মাছবাজারের শেড আর পাইকারি মাছবাজারের মাঝে রাস্তা। সেই রাস্তার দুপাশে চৌকি পেতে বসে মাছ বিক্রেতারা মাছ বিক্রি করেন। বর্ষা না থাকলেও সেখানে সারা বছরই কাদা থাকে। প্রতিমাদেবী বললেন, “মাছ বাজারে এই অবস্থা দেখে আসতে ইচ্ছে করে না। একটা শাড়ি পরে আসলে বাড়ি গিয়ে পাল্টাতে হয়।”
জলপাইগুড়ি শহরের মধ্যে প্রধানত মাছ বিক্রি হয় দু’টি বাজারে। একটি দিনবাজারে, অন্যটি স্টেশন বাজারে। দু’টি বাজারেরই হাল এমনই। এ ছাড়াও বয়েলখানা পৌরবাজার, বউবাজার, ইন্দিরা কলোনি, মিউনিসিপ্যাল মার্কেট এলাকাতেও অল্পস্বল্প খুচরো মাছ বিক্রি হয়।
দিনবাজারের মাছবাজার পুরনো এবং প্রধান বাজার। জলপাইগুড়ি জেলা এবং হলদিবাড়ি এলাকার মাছের ব্যবসায়ীরা এবং মৎস্যরসিক বাসিন্দারা এই বাজারটির উপরেই নির্ভরশীল। বাজারটি জলপাইগুড়ি পুরসভার নিয়ন্ত্রণাধীন। স্টেশন বাজারটি অপেক্ষাকৃত ছোট। এখানে দিনবাজার থেকে নিলামে মাছ কিনে নিয়ে এসে খুচরো ব্যবসায়ীরা বিক্রি করেন। স্থানীয় ভাবে যারা পুকুর এবং নদী থেকে মাছ নিয়ে আসেন তাঁদের মাছও পাইকারি ভাবে বিক্রি হয়। বাজারটি রেলের জমিতে বসে। পুরসভার কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই।
বাজার দু’টির বেহাল অবস্থা নিয়ে এমন অভিজ্ঞতা প্রতিমা দেবের একার না। শহরের যে সমস্ত বধূ রোজ মাছ বাজারে আসেন, একই অভিজ্ঞতা তাদের সকলের। শনিবার দিনবাজারে মাছ কিনতে এসেছিলেন শহরের পবিত্রপাড়ার শীলা সরকার। স্বামী ব্যবসায়ী। শীলাদেবী রোজ নিজেই বাজার করেন। মাছ কিনে টাকা দেওয়ার ফাঁকে তিনি বললেন, “বাজারে এত দুর্গন্ধ যে ঢোকা যায় না। মনে হয় চার পাশে একটা
বিষাক্ত পরিবেশ।”
হাসপাতালপাড়ার বাসিন্দা পেশায় চিকিৎসক দেবব্রত গোস্বামীও একমত। তিনি বলেন, “দিনবাজার থেকে শিল্পসমিতিপাড়ায় যাওয়ার রাস্তা এই মাছ বাজারের মধ্যে দিয়েই। এই সরু কাদায় ভরা পথ দিয়ে সাইকেল তো চলেই, মোটরবাইকও চলাচল করে। তখন ক্রেতারা সকলেই অসুবিধায় পড়েন।” কেবল ক্রেতাদের হয়রানিই নয়, অপরিকল্পিত ভাবে বাজার তৈরি হওয়ায় নিকাশি নেই। আবর্জনা করলা নদীতে পড়ে নদীর দূষণ ঘটাচ্ছে।”
দিনবাজার ব্যবসায়ী সমিতি সুত্রে জানা যায়, মাছ বাজারে মোট ২৩ জন পাইকারি বিক্রেতা আছেন। খুচরো ব্যবসায়ী, যাঁরা পুরসভার তৈরি শেডের নীচে পাকা জায়গার ওপর দোকান করে আছেন তাঁদের সংখ্যা ২২। অনথিভুক্ত ভাবে রোজ যারা মাছ নিয়ে বাজারে বসেন তাঁদের সংখ্যা ৫০। মাছ বিক্রেতাদের পুরনো জায়গা ছিল বাজারের অনেকটা আগে। এখন যেখানে পুরসভার ভবন উঠেছে সেখানে একই রকম শেডের নীচে মাছ বিক্রি হত। ১৯৮২ সাল বাজারটি একটু দূরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। তখনও বাজারের কাঠামোটি একই রকম রেখে দেওয়া হয়।
দিনবাজারের বেহাল অবস্থা নিয়ে ক্রেতাদের মতো সরব হয়েছেন বিক্রেতারাও। মাছ ব্যবসায়ী রাজু সাহারা তিন পুরুষ ধরে মাছ বিক্রি করছেন। পুরসভার তৈরি বাঁধানো জায়গার ওপরে বসেন। নীচে ছোটখাটো গুদাম। বললেন, “গোটা বাজারটাই অপরিচ্ছন্ন। নিয়মিত বাজার ধোওয়ার ব্যবস্থা নেই। জলের অভাব। পুরসভার পক্ষ থেকে আধুনিক মাছ বাজার তৈরির পরিকল্পনা কোনও দিন নেওয়া হয়নি বলেই এই অবস্থা।” বর্ষাকালে অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যায়। বাজারে শেডের টিন ফুটো হয়ে জল পড়ে। শেডের কাঠের খুঁটিগুলো পচে যাচ্ছে।
দিনবাজারে খুচরো ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মাছ কিনে বাসিন্দারা মাছ কাটিয়ে নিয়ে যান। যাঁরা মাছ কাটেন তাঁদের সংখ্যা ১৬। তাঁরা মাছ কাটার পর আবর্জনা নিয়ে ফেলে আসেন। কিন্তু প্রয়োজনীয় জল না থাকায় ধুতে পারেন না। যেখানে মাছ বিক্রি হয় একই জায়গায় মাছ কাটাও হয়। দিনবাজারে মাছ কাটা যাদের পেশা তাঁদের মধ্যে বসন্ত দাস, সুভাষ সাহারা বললেন, “বাজারের চার প্রান্তে চারটে কল আছে। সবসময় জল থাকে না। ইচ্ছে থাকলেও আমরা সমস্ত জায়গা ধুতে পারি না।”
তাই ঘিঞ্জি-নোংরা বাজারে মাছ কিনে ফিরে পোশাক না পাল্টে উপায় থাকে না বাসিন্দাদের। (চলবে)।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy