Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

স্কুলপড়ুয়াদের প্রেরণার স্বীকৃতি জাতীয় পুরস্কারে

স্কুলছুট পড়ুয়া রাখবেন না এটাই ছিল তাঁর প্রতিজ্ঞা। দু’দিন কোনও পড়ুয়া স্কুলে না এলে ছুটির পর প্রত্যন্ত এলাকায় তাদের বাড়িতে চলে যান। অভিভাবকদের বুঝিয়ে স্কুলে পাঠানোর ব্যবস্থা করে তবে বাড়ি ফেেরন। কোনও পড়ুয়া অসুস্থ হলে অনেক ক্ষেত্রে নিজেই চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান। স্কুলেই রাতের পর রাত কাটিয়ে ভবনের নির্মাণ কাজ করিয়েছেন। এ হেন প্রধান শিক্ষকা চায়না কুণ্ডু পালকে পেয়ে খুশি গ্রামের বাসিন্দারাও।

চায়না কুণ্ডু পাল। নিজস্ব চিত্র।

চায়না কুণ্ডু পাল। নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০২:০৬
Share: Save:

স্কুলছুট পড়ুয়া রাখবেন না এটাই ছিল তাঁর প্রতিজ্ঞা। দু’দিন কোনও পড়ুয়া স্কুলে না এলে ছুটির পর প্রত্যন্ত এলাকায় তাদের বাড়িতে চলে যান। অভিভাবকদের বুঝিয়ে স্কুলে পাঠানোর ব্যবস্থা করে তবে বাড়ি ফেেরন। কোনও পড়ুয়া অসুস্থ হলে অনেক ক্ষেত্রে নিজেই চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান। স্কুলেই রাতের পর রাত কাটিয়ে ভবনের নির্মাণ কাজ করিয়েছেন। এ হেন প্রধান শিক্ষকা চায়না কুণ্ডু পালকে পেয়ে খুশি গ্রামের বাসিন্দারাও। শিলিগুড়ির প্রত্যন্ত এলাকায় সেফদুল্লা জোত প্রাথমিক স্কুলের ওই প্রধান শিক্ষিকাকে তাঁর কাজের জন্য জাতীয় পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে। স্কুল পরিদর্শকের দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, শিক্ষক দিবসের দিনই এই পুরস্কার দেওয়া হয়।
রাজ্যের যে আট জন শিক্ষক-শিক্ষিকাকে এ বছর এই সম্মান দেওয়া হচ্ছে তার মধ্যে চায়নাদেবী অন্যতম। তিনি ছাড়া দার্জিলিং জেলার মিলন সঙ্ঘ প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক নিমবাহাদুর তামাঙ্গ এই পুরস্কার পাচ্ছেন। সোমবার শিলিগুড়ির স্কুল পরিদর্শক (প্রাথমিক) বিজয়লক্ষ্মী পালের দফতরে ওই চিঠি পৌঁছয়। তিনি বলেন, ‘‘এটা আমাদের কাছে অত্যন্ত গর্বের বিষয়। চায়নাদেবী, নিমবাহাদুর তামাঙ্গদের এই স্বীকৃতি অন্য শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অনুপ্রাণিত করবে বলে আশাবাদী।’’
আগামী ৫ সেপ্টেম্বর নয়াদিল্লিতে বিজ্ঞান ভবনে আনুষ্ঠানিক ভাবে ওই সম্মান তুলে দেওয়া হবে। শংসাপত্র, নগদ ৫০ হাজার টাকা এবং একটি রুপোর মেডেল দেওয়া হয়। স্বামী মনোরঞ্জনবাবুকে নিয়ে অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাচ্ছেন চায়নাদেবীও। পরিবার এবং স্কুল সূত্রে জানা গিয়েছে, ১৯৯৫ সালে বেঙ্গাইজোত প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন চায়নাদেবী। ২০০২ সালে বর্তমান স্কুলে যোগ দেন। তখন স্কুলের চালাঘরে ক্লাস হত। এলাকার পরিবেশও ছিল অন্য রকম। রাতে স্কুলের চাল চুরি হয়ে যেত। এসব দেখে সেখানে মন টিকত না তাঁর। ভেবেছিলেন অন্যত্র চলে যাবেন কি না?
কিন্তু কচিকাঁচা পড়ুয়াদের মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি ছেড়ে যেতে পারেননি। আর এখন তিনি স্কুলের পড়ুয়া থেকে অভিভাবক সকলের কাছে তাদের সবার প্রিয় ‘ম্যাডাম’ নামেই পরিচিত হয়ে উঠেছেন। এলাকার বাসিন্দা প্রতিবন্ধী কিশোরী পূর্ণিমা বিশ্বাসকে তো তিনি স্কুলে আসতে উৎসাহ দিয়েছেন। সারা দিন জানলা বন্ধ করা ঘরে পড়ে থাকত পূর্ণিমা। মা নেই। বাবা সব্জি বিক্রেতা। চায়নাদেবী খবর পেয়ে তার বাড়িয়ে যান। পূর্ণিমার বাবাকে বুঝিয়ে তাকে স্কুলে আনার ব্যবস্থা করেন। টুলটুলি বর্ম, শম্পা সিংহদের বুঝিয়ে স্কুলে পড়াশোনা করিয়েছেন। চা বাগান এলাকার বাসিন্দাদের ছেলেমেয়েরা, আদিবাসী শিশুরাই মূলত তাঁর স্কুলের পড়ুয়া। রয়েছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ছাত্রছাত্রীরাও। তাঁর হাত ধরেই এখন স্কুলের দোতলা ভবন গড়ে উঠেছে।

চায়নাদেবী বলেন, ‘‘কাজ করলে যে এমন স্বীকৃতি মেলে এটা কখনও ভাবিনি। খুব ভাল লাগছে। তবে স্কুলের অন্যান্য শিক্ষকরা আমাকে যে ভাবে সাহায্য করেন তা বলতেই হবে। অভিভাবকদের অনেকেই সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন।’’ কী করে গরিব ছাত্রছাত্রীদের সাহায্যে করেন সে কথা বলছিলেন। কী করে স্কুল পরিদর্শকের দফতরে গিয়ে, প্রশাসনকে বলে স্কুলের ভবন, পাঁচিলের ব্যবস্থা করেছেন সে কথা। এখন স্কুলে সব মিলে ৩০০ পড়ুয়া। বলেন, ‘‘এই স্কুল ছেড়ে আর তখনও থাকতে পারব না। তাই অবসরের সময় হলে কী করব বুঝতে পারছি না।’’ আনন্দে তাঁর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE