রাজ আমলের পুরনো বাড়ি সংস্কারের অভাবে বেহাল।
একসময় এই বাড়ি থেকেই পরিচালনা করা হতো রাজ্যপাট। নগরীর রাজপথে দেখা মিলত হাতি-ঘোড়া, সৈন্য-সামন্তের। ঘুরে বেড়াতেন রানিরা। সন্ধ্যায় কান পাতলে শোনা যেত, নর্তকীদের ঘুঙুরের আওয়াজ। এখনও কোচবিহারের অলিগলিতে রাজ আমলের পুরনো ইতিহাসের সাক্ষ্য রেখে দাঁড়িয়ে রয়েছে বড় বড় বাড়ি। সে আমলের স্থাপত্যের নিদর্শন ছড়িয়ে রয়েছে শহরের চার দিকে।
বড় বড় প্রাসাদের সামনে শয়নকক্ষ, সাজঘর, উপবেশন কক্ষ, বিলিয়ার্ড খেলার ঘর, পাকশালা, ভোজনকক্ষ, পুস্তকাগার, তোষাখানা, অন্দরমহলে স্থাপত্য-শিল্পের ছড়াছড়ি।
এখন আর রাজা নেই। রাজশাসনও নেই। শহর জুড়ে ছড়িয়ে থাকা পুরনো বাড়িগুলির মধ্যে কয়েকটিতেই ‘হেরিটেজ’-এর তকমা মিলেছে। যেগুলির কপালে সেই তকমা জোটেনি, সেগুলি নষ্ট হতে বসেছে সংস্কারের অভাবে। কিছু কিছু বাড়ি এখন সরকারি অফিস।
অথচ এই বাড়ি, স্থাপত্যের হাত ধরেই একটা পরিচয় ছিল কোচবিহার শহরটার। কিন্তু সেগুলি সংরক্ষণ করা হয়নি, সেগুলি রক্ষায় জনমত গঠনে সেভাবে সরব হননি শহরের বাসিন্দারা। বিচ্ছিন্ন ভাবে কয়েক জন সরব হয়েছেন। কয়েক জন মিলে গড়ে তুলেছেন কোচবিহার হেরিটেজ সোসাইটি।
অথচ এই কোচবিহার থেকে কোনও আমলেই জনপ্রতিনিধির সংখ্যা কম পড়েনি। রাজনৈতিক দলগুলিও এই ইতিহাস রক্ষায় কখনও কোনও জোরদার আন্দোলন করেছে বলে মনে পড়ে না।
শুধুমাত্র রাজবাড়ির ভবনটিকে নিজেদের দায়িত্বে নিয়েছে পুরাতত্ত্ব বিভাগ। সেখানে মাঝেমধ্যে কিছু সংস্কারের কাজ করা হয়। পুরাতত্ত্ব বিভাগের পক্ষ থেকে একাধিক বার কয়েন মিউজিয়াম বা অস্ত্রাগারটি পর্যটকদের জন্য খুলে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানানো হলেও তা হয়নি। অন্য বাড়িগুলির অবস্থা আরও খারাপ।
রাজবাড়ি থেকে এক কিলোমিটার দূরেই সাগরদিঘি দিঘির চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে স্থাপত্য। একশো বছর আগে রাজকুমার ভিক্টর নৃপ্যেন্দ্র নারায়ণের জন্য তৈরি হয়েছিল ভিক্টর প্যালেস। মহারানি ভিক্টোরিয়া রাজকুমারকে ওই উপাধি দিয়েছিলেন। রাজকুমার তাঁর স্ত্রী নিরুপমা দেবীকে নিয়ে সেখানে থাকতেন। সেই ভিক্টর প্যালেস এখন হয়েছে রাজবংশী ভাষা অ্যাকাডেমির অফিস।
তার আগে পর্যন্ত ওই ভবনের হাল দেখলে শিউরে উঠতে হতো। ঝোপ জঙ্গলে ভরে গিয়েছিল চারিদিক। সরকারি অফিস হওয়ার পরে তা সংস্কার করা হয়েছে।
পাশেই রয়েছে কোচবিহার জেলাশাসকের পুরনো অফিস। ল্যান্সডাউন হল নামেই তা বিখ্যাত। এক সময়ে অতিথিদের আপ্যায়ণের জন্য ওই ভবন তৈরি করেছিলেন মহারাজা। পাশেই পরিবহণ দফতরের অফিস, মহকুমাশাসকের অফিস, আদালত ভবন, অনগ্রসর কল্যাণ দফতরের অফিস।
মতিমহল প্রধান ডাকঘর জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকের অফিস। লালবাগ আনন্দ আশ্রম পুলিশ অফিসারের কোয়ার্টার। পারিজাত ভিলা জেলা জজের আবাসস্থল। সার্কিট হাউস চিলারায় ব্যারাকে একসময় রাজার সৈন্য থাকত। এখন তা ভারতীয় সেনার ক্যাম্প হয়েছে।
রানিদের সমাধিস্থল এখন হয়ে উঠেছে রানিবাগান ভোলা আশ্রম। পূর্ত দফতরের বাস্তুকারের আবাস ব্রাহ্ম মন্দির। কুমার গজেন্দ্র নারায়ণ স্ত্রী সাবিত্রীদেবীকে নিয়ে যে বাড়িতে থাকতেন সেটি এখন সাবিত্রী লজ নামে পরিচিত। তার অবস্থাও এখন ভাল নয়।
মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ থেকে শুরু করে জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ শিক্ষা ও খেলাধূলা ভালবাসতেন। তাই গড়ে ওঠে জেনকিন্স স্কুল, এবিএনশীল কলেজ। সাধারণ মানুষের সেবার জন্য গড়া হয় হাসপাতাল। সেগুলির কোনওটি হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করা হয়নি।
(চলবে)
ছবি: হিমাংশুরঞ্জন দেব।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy