Advertisement
১৭ এপ্রিল ২০২৪

সাহেবি মেজাজেই বেড়েছে মালবাজার

‘আমার শহর নয়কো তেমন বুড়ো/ পুরাকালের অস্থিমুদ্রা চৈত্য বিহার কিছু পাবে না তো তার কোথাও মাটি খুঁড়ে/ হঠাত্‌ কখন নদীর ধারে ব্যাপারিদের নায়ে/ আমার শহর নেমেছিল কাদামাখা পায়ে...’

মালবাজারের নেতাজি মোড়ে রঙিন ফোয়ারা।

মালবাজারের নেতাজি মোড়ে রঙিন ফোয়ারা।

সব্যসাচী ঘোষ
মালবাজার শেষ আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০১৪ ০১:২০
Share: Save:

‘আমার শহর নয়কো তেমন বুড়ো/ পুরাকালের অস্থিমুদ্রা চৈত্য বিহার কিছু পাবে না তো তার কোথাও মাটি খুঁড়ে/ হঠাত্‌ কখন নদীর ধারে ব্যাপারিদের নায়ে/ আমার শহর নেমেছিল কাদামাখা পায়ে...’

শহর মালবাজারে পুরাকালের কোনও নিদর্শন নেই। উত্তরবঙ্গের অনেক শহরের থেকে বয়সেও নবীন মালবাজার। শহর কলকাতার জন্যে প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘শহর’ কবিতাটি তাই অনেকটাই প্রাসঙ্গিক মালবাজারের ক্ষেত্রেও। এখন যেখানে মালবাজার শহরের অবস্থান, সেখানে ৮০ বছর আগেও ছিল জঙ্গল। হাতিদের আনাগোনা, চিতাবাঘের হানা। এটাই ছিল নিত্যদিনের ছবি।

ডুয়ার্সের বিরাট চা বলয়কে পরিষেবা জোগাতে মালবাজারের পত্তন। ১৮৫০ সালের পর থেকেই ডুয়ার্সে একে একে চা বাগান হয়। নতুন শতাব্দীর দোরগোড়ায় গিয়ে মালবাজারে দোকান-বাজার চালুর চেষ্টা করেন ইংরেজরাই। এখনও ডুয়ার্সের ৬০টিরও বেশি চা বাগানের শ্রমিকেরা মালপত্র কেনাকাটা করতে মালবাজারেরই হাট-বাজারের ওপর নির্ভর করেন। সেদিনও চা বাগান গুলোকে পরিষেবা জোগাতেই মালবাজারের গড়ে ওঠা। তবে মালবাজারের নাম কীভাবে মালবাজার হয়েছে এ নিয়ে অবশ্য তিনটি মত প্রচলিত। এক, যেহেতু চা বাগানের জন্যে বিরাট পণ্য বা মাল কেনাবেচার বাজার বসত, মালবাজার শহরে সেই মাল থেকেই শহরের নাম হয়েছে মালবাজার।

দুই, ডুয়ার্স মানেই ম্যালেরিয়া প্রবণ। ম্যালেরিয়া কথাটির থেকেই নাম হয়েছে মাল। পরে মালবাজার।

তিন, মালবাজার শহরে ম্যাল সাহেব নামে এক ইংরেজ সাহেব বিংশ শতকের গোড়ায় শহরে থাকতেন। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে, আড্ডা জমাতে, সন্ধ্যার পরে চা বাগানের ম্যানেজার সাহেবরাও যেতেন। সেই ম্যাল সাহেবের নামের থেকেই মালবাজার।

কেমন ছিল শতবর্ষ আগের মালবাজারের ছবি?

প্রতিটি চা বাগানে এক জন করে ম্যানেজার থাকতেন। সে সময় প্রতিটি বাগানেই ইংল্যান্ড থেকেই সরাসরি ম্যানেজার নিয়োগ করা হতো। বাগানের অলিখিত নিয়ম মোতাবেক ম্যানেজার বাগানের কোনও অধীনস্থ কর্মীদের সঙ্গেই ব্যক্তিগত সম্পর্ক তৈরি করতে পারতেন না। কড়া শাসনে যাতে বাগান চলে তার জন্যেই এই নিয়ম আজও চালু অনেক জায়গায়।

তাই ভোর থেকে চা বাগানের কাজ করে দুপুরে পর হাঁফিয়ে উঠতেন বাগান ম্যানেজারেরা। এই ক্লান্তি কাটাতেই আশপাশের সব ম্যানেজারেরা বিকেল থেকেই মালবাজারে জমা হতেন। একসঙ্গে গল্প, আড্ডায় মেতে উঠতেন। ইংরেজদের হাত ধরেই ১৯১০ সালের কাছাকাছি কোনও এক সময়ে মালবাজার শহরে গড়ে ওঠে ইউরোপিয়ান ক্লাব। সেই ক্লাব ঘরের সামনে বিরাট গল্ফ আর পোলো খেলার মাঠ।

শহরের কেন্দ্রস্থলে ঘড়ির মোড়।

এখন অবশ্য ক্লাব আর মাঠ কোনওটারই কোনও অস্তিত্ব নেই। এখন সন্ধেবেলায় রঙিন আলোয় আলোকিত হয় ফোয়ারা। ঘড়ির মোড়ের সংকীর্ম রাস্তা হয়েছে অনেক চওড়া। আজ যেখানে সরকারি আবাসন, বন দফতরের অফিস, পুষ্পিকা হিন্দি স্কুল গড়ে উঠেছে, সেখানেই ছিল ইউরোপিয়ান ক্লাবের গলফ আর পোলো খেলার মাঠ। স্বাধীনতার পরেও সাহেবরা ঘোড়ায় চেপে পোলো খেলছেন, এ দৃশ্য চোখ বন্ধ করলে আজও দেখতে পান মালবাজারের আশি পেরোনো প্রবীণ নাগরিক বিদ্যুত্‌ সরকার।

ইংরেজদের জন্যে ১৯৪০-এর দশকেই মালবাজারে গড়ে ওঠে শপিং মল। যে সময় শপিং মল কথাটিরই কোন প্রচলন ছিল না। সে সময় মালবাজারে এক ছাদের নিচেই সাহেবদের জন্যে গড়ে উঠেছিল বিরাট বাজার। মালবাজারেরই স্থানীয় উদ্যোগপতি মাখন বসু ‘ডুয়ার্স মিউজিক হল’ নামের এই শপিং মলটি গড়ে তুলেছিলেন। ডুয়ার্সের প্রবাদ বাক্য হয়ে উঠেছিল যে, ‘মাখন বাবুর ডুয়ার্স মিউজিক হলে পিন থেকে এলিফ্যান্ট’ সবই পাওয়া যেত। এই ডুয়ার্স মিউজিক হলের পেছনেই পানোয়ার বস্তি এলাকাতে ছিল চিনা কাঠমিস্ত্রিদের ডেরা। তাঁরা কাঠের আসবাব তৈরি ও শৌখিন জুতো তৈরির কাজ করতেন। ১৯৬২ সালে ভারত চিন যুদ্ধের পর সব চিনারা অন্যত্র সরে যান।

ইংরেজদের কথা মালবাজারের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। ইংরেজ আমলে নানা আন্দোলনের ক্ষেত্রেও মালবাজার তাত্‌পর্যপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। বিশেষত, চা শ্রমিক সংগঠন, তেভাগা আন্দোলনেও মালবাজারের নাম ওতপ্রোত ভাবে যুক্ত। ইতিহাস সে কথাই বলে। রাজ্যে শাসন ক্ষমতা পরিবর্তনের পরে অন্য জায়গার মতো মালবাজারেও ঘাসফুলের আধিপত্য ক্রমশ বাড়ছে। কিন্তু, অতীতের দিকে তাকালে দেখা যায় মালবাজারের মানুষ বরাবরই প্রতিবাদীদের সঙ্গে থাকতে পছন্দ করেছেন।

ছবি: দীপঙ্কর ঘটক।
(চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE