অপহরণের ঘটনায় অভিযুক্তেরা। নিজস্ব চিত্র।
দাবি মতো টাকা দিতে না পারায় মৃত্যু যে নিশ্চিত বুঝে গিয়েছিলেন। আর এরপরেই অপহরণকারীদের মুহূর্তের অসতর্কতার সুযোগ নিয়ে চলন্ত গাড়ির দরজা খুলে রাস্তায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন এমএ পড়ুয়া এক যুবক। মালদহের হরিশ্চন্দ্রপুরের বিহার সীমানা ঘেঁষা কুশিদা এলাকায় বৃহস্পতিবার রাতে সেই সময়ে ওই এলাকা দিয়েই যাচ্ছিলেন কয়েকজন শ্মশানযাত্রী। তাঁরা হইচই করে উঠতেই ছুটে আসে পুলিশ। তাতেই ধরা পড়ে চার অপহরণকারী।
পুলিশ জানিয়েছে, অপহৃত যুবকের নাম আসরাফুল আলম। বাড়ি উত্তর দিনাজপুরের ইটাহারের টেকুড় এলাকায়। বুধবার রাতে মালদহ শহর থেকে অপহৃত হন দিনমজুর পরিবারের ছেলে আসরাফুল। অপহরণের পর তিন লক্ষ টাকা মুক্তিপণ চেয়ে তাঁর বাড়িতে একাধিকবার ফোনও করে দুষ্কৃতীরা। দিনমজুর জেনে পরে তা দেড় লক্ষ টাকায় নেমে যায়। পুলিশকে জানালে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়। তাই আসরাফুলের পরিবার পুলিশকে কিছু জানায়নি। বরং ধার দেনা করে ৬০ হাজার টাকা সংগ্রহও করেছিলেন। সে টাকা আসরাফুলের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে রাখা হয়। আসরাফুলের এটিএম কার্ড দিয়েই সে টাকা তুলে নেয় দুষ্কৃতীরা। কিন্তু তাতেও মন গলেনি অপহরণকারীদের।
প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ জানতে পেরেছে, অপহরণের পরে আসরাফুলকে কয়েকদিন বিহারের কোথাও নিয়ে গিয়ে রাখা হয়েছিল। তারপরে আস্তানা বদলের চেষ্টা করে তারা। সে সময়েই সুযোগ বুঝে গাড়ির দরজা খুলে ঝাঁপিয়ে পড়েন আসরাফুল। ঘটনাচক্রে তখন কাছেই ছিল হরিশ্চন্দ্রপুরের আইসি-র নেতৃত্বে পুলিশের একটি টহলদারি দল। ধৃতদের কাছ থেকে এটিএম থেকে তোলা ৪০ হাজার টাকা সহ গুলি ভর্তি একটি নাইন এমএম পিস্তলও পুলিশ উদ্ধার করেছে। ধৃতরা হল দুলাল শেখ, আলম শেখ, এনামুল শেখ ও দবিড় শেখ। প্রথম তিন জন ইংরেজবাজারের নাগরাই-লক্ষ্মীপুর ও চতুর্থ জন বৈষ্ণবনগরের দৌলতপুরের বাসিন্দা।
আগেও একাধিক অপহরণের ঘটনায় ওই দুষ্কৃতী দলটি জড়িত ছিল বলে পুলিশ জানতে পেরেছে। মালদহের পুলিশ সুপার প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “মুক্তিপণ আদায় করতে ওই যুবককে অপহরণ করা হয়েছিল। ৪ অপহরণকারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ওই চক্রে আরও কয়েকজন রয়েছে বলে আমাদের সন্দেহ। প্রত্যেককেই ধরা হবে।”
পুলিশ ও অপহৃতের পরিবার সূত্রে জানা যায়, আসরাফুল রায়গঞ্জ ইউনিভার্সিটি কলেজে বাংলায় এমএ পড়েন। তাঁর বাবা নেই। দিনমজুর দাদারাই পড়াশুনার খরচ জোগান। কলকাতায় চাকরির ইন্টারভিউ দিয়ে বুধবার রাতে তিনি মালদহে পৌঁছন। রাত ১০টায় শহরের ৪২০ মোড়ে ইটাহার যাওয়ার গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিলেন। ওই সময় একটি সাদা ছোট গাড়ি তাঁর পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। গাড়িটি ইটাহার যাওয়ার কথা বলে তাকে তুলে নেয়। গাড়িতে আগে থেকেই দুই যাত্রী ছিল। পরে আরও দু’জন ওঠে। খানিক বাদেই দুষ্কৃতীরা মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে তাঁর মুখে কাপড় গুঁজে দিয়ে চোখও বেঁধে ফেলে।
পরিবার সূত্রে জানা যায়, আসরাফুলের মোবাইল থেকে দাদা আখতার হোসেনকে ফোন করে মুক্তিপণের কথা জানায় দুষ্কৃতীরা। আসরাফুলও জানায় যে, এখুনি টাকার ব্যবস্থা না করলে ওরা তাকে মেরে ফেলবে। ছেলেকে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়ায় মা নুরনেহার বেওয়া পুলিশে অভিযোগ জানাতে দেননি। তার পর আসরাফুলের এটিএমে বৃহস্পতিবার ৬০ হাজার টাকা জমা করা হয়। ওই দিন কাটিহারের একটি এটিএম থেকে ৪০ হাজার টাকা তুলে নেয় দুষ্কৃতীরা।
এদিন চাঁচল মহকুমা আদালতে এসে অপহৃতের দাদা আখতার হোসেন বলেন, “আমরা গরিব মানুষ। ৬০ হাজার টাকা দিলেও ওরা ভাইকে ছাড়তে চায়নি। ক্রমাগত ভাইকে মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছিল।”
এদিন আসরাফুল জানান, অপহরণ করার পর থেকে আমার উপরে অকথ্য অত্যাচার চালায় দুষ্কৃতীরা। মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে আমাকে গাড়িতে করে অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। ওই সময় একটি এলাকা দিয়ে যাওয়ার সময় দেখি যে শবদেহ নিয়ে কিছু শ্মশানযাত্রী যাচ্ছেন। মরিয়া হয়ে কোনমতে গাড়ির দরজা খুলে নীচে ঝাঁপিয়ে পড়ি।
মালদহের ওই মোড় কিন্তু সারা দিনই বেশ সরগরম থাকে। জাতীয় সড়কের উপরে এই মোড়ে রাত দশটা পর্যন্ত যথেষ্টই লোকজন থাকেন। খোলা দোকানপাটও। তার মধ্যে কী করে এক যুবককে অপহরণ করা হল? প্রাথমিক তদন্তে পুলিশের ধারণা, কোনও থেকে কোনও লক্ষ্য ঠিক করে দুষ্কৃতীরা পথে নামেনি। আসরাফুল সে দিন কলকাতায় গিয়েছিলেন। তাঁকে দেখে দুষ্কৃতীরা ভেবেছিল যে, তিনি বিত্তবান পরিবারের ছেলে। তাই তাঁকে অপহরণ করা হয়। তবে মালদহ থেকে ইটাহার যাওয়ার বাস রাত সাড়ে সাতটার পর থেকে বন্ধ হয়ে যায়। তখন ওই এলাকায় ছোট গাড়িগুলিই চলে। এ ছাড়া মেলে দূরপাল্লার বাস। তাই আসরাফুলের মতো অনেকেই রাতে ওই ছোট গাড়িগুলি ধরেন। পুলিশ জানিয়েছে, আসরাফুলের মতো অন্য কেউ যাতে এমন বিপদে না পড়েন, তাই ওই এলাকায় ভাল ভাবে টহল দেওয়া হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy