শিকারের নিশানা এই পাখিরাই। — নিজস্ব চিত্র
শীতের মরসুমে আঁধার নামতেই ফাঁকা হয়ে যায় নদীর আশপাশ। কিন্তু রাত নামতেই অন্য ছবি। নিশুত রাতে শান্ত জলে চলে নৌকার আনাগোনাও। ডিঙি কিংবা পানসি নৌকার থেকে চরের ঝোপে জাল আছড়ে পড়ে। ডানা ঝাপটানোর শব্দে খানখান হয় নিস্তব্ধতা। নৌকায় থাকা শিকারিরা টের পায় পাখি এখন জালে। জাল ভরা পাখি নিয়ে ফিরে যায় নৌকাগুলি।
প্রতি রাতের অন্ধকারে এ ভাবেই রুডি শেলডাক, রিভার লেপউইং, নানা বিরল প্রজাতির হাঁস-সহ নানা পরিযায়ী পাখি শিকার করে পাচার হয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন রেস্তোরাঁয়। অন্তত এমনটাই অভিযোগ শিলিগুড়ি শহর লাগোয়া ফুলবাড়ির নিজবাড়ি এলাকার বাসিন্দাদের। এক একটি পাখির দাম নূন্যতম ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা। জীবিত হোক বা মৃত, দরের কোনও হেরফের হয় না।
ফুলবাড়ি-গজলডোবার তিস্তা ক্যানালের হইহুল্লোড় পরিবেশের আশ্রয় ছেড়ে কয়েক কিলোমিটার দূরে নিরিবিলিতে আশ্রয় খুঁজে নিয়েছিল একদল পরিযায়ী। প্রায় সাত বছর আগের কথা। তারপর থেকে পরিযায়ীর দল নিয়মিত আসে ওই ঠিকানায়। বেশি লোক জানাজানি না হওয়ায় পর্যটকদের দেখা মেলে না। সেই আশ্রয়ে এখন শুরু হয়েছে চোরাশিকারীদের হানা।
সরকারি ভাবে এলাকাটি চিহ্নিত ফুলবাড়ি ২ গ্রাম পঞ্চয়াতের পশ্চিম ধনতলা হিসেবে। শিলিগুড়ি থেকে ফুলবাড়ি যাওয়ার পথে জাতীয় সড়ক থেকে বাঁ দিকে নেমে মহানন্দা ক্যানাল ধরে গেলেই মিলবে পরিযায়ীদের ঠিকানা। বাসিন্দাদের কাছে এলাকাটি পরিচিত নিজবাড়ি নামে। বছর কয়েক আগের গজিয়ে ওঠা কলোনি। পাখি বাসা বাঁধার পরে বন দফতর থেকে দু-এক বার সমীক্ষাও হয়েছে। বনকর্মীরা বাসিন্দাদের বলে গিয়েছেন পাখিদের নজরে রাখার কথা। পাখিদের সুরক্ষা বলতে পঞ্চায়েতের লাগানো দু’টো সাইনবোর্ড।
ভূত নাকি বাসা বেঁধেছে সর্ষের মধ্যেই। অভিযোগ, চোরাশিকারীদের মদত করে বাসিন্দাদের একাংশও। পাখি পিছু কমিশন মেলে ৫০ থেকে ১০০ টাকা। এক রাতে নৌকা শিকারে অন্তত ২০টি পাখি ধরা পড়ে। অর্থাৎ কমিশন এক থেকে দু’হাজার টাকা। শীতের মরসুম পড়তেই হোটেল, রিসর্টে শুরু হয় ‘বন ফায়ার’। হোটেল কর্মীদের একাংশের দাবি, একটি বালিহাঁস অথবা ব্রাহ্মণী হাঁসের দাম ওঠে হাজার টাকারও বেশি।
এলাকায় নিয়মিত ছবি তুলতে যাওয়া শিলিগুড়ির দেশবন্ধুপাড়ার বাসিন্দা পাপুন ভট্টাচার্যের দাবি, ‘‘ইদানিং পাখির সংখ্যা কমে যাচ্ছে।’’ বালিহাঁস, ব্রাহ্মণী হাঁস ছাড়াও মাছরাঙা ছাড়াও রিভার লেপউইং, তথা নদী তিতির, কোঁচ বক, গ্রিটার ফ্লেমিংগো, মাছরাঙার নানা প্রজাতি এলাকায় আসে। এলাকার যুবক নজরুল হক, রাজ সরকার, রঞ্জিত থাপার অভিযোগ, ‘‘রোজ রাতে মাছ ধরার নাম করে পাখি শিকার হয়।’’
ঘটনাটি জানেন পঞ্চায়েত প্রধান নৃপেন্দ্রনাথ রায়ও। তাঁর কথায়, ‘‘সবই জানি। বন দফতর প্রশাসনকেও জানিয়েছি।’’ কিন্তু পরিযায়ী পাখি শিকার পুরোপুরি বেআইনি। তা হলে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না কেন? শিলিগুড়ির পুলিশ কমিশনার চেলিং সিমিক লেপচা বলেন, ‘‘এখনও কোনও অভিযোগ হয়নি। খোঁজ নিয়ে দেখছি।’’ উত্তরবঙ্গের বনপাল (বন্যপ্রাণী) সুমিতা ঘটক জানালেন, ‘‘এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে সচেতনতা প্রসার করে প্রতিরোধ তৈরি করাই চোরাশিকার বন্ধের একমাত্র উপায়। সেই প্রক্রিয়া শুরু করবে বন বন দফতর।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy