Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

আদর্শ শিক্ষা

বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করিবার পূর্বেই নিজেকে শেষ করিয়াছিলেন। তবু তাঁহারই নাম বার বার উচ্চারিত হইল বিশ্ব শিক্ষা সম্মেলনে।

সম্পাদকীয় ২
শেষ আপডেট: ১২ জানুয়ারি ২০১৭ ০০:১৭
Share: Save:

বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করিবার পূর্বেই নিজেকে শেষ করিয়াছিলেন। তবু তাঁহারই নাম বার বার উচ্চারিত হইল বিশ্ব শিক্ষা সম্মেলনে। রোহিত ভেমুলা এ দেশে শিক্ষাবঞ্চনার দীর্ঘ ইতিহাসের নিদর্শন, বলিলেন আভা শূর। তাঁহার বক্তব্য, ইংরেজ আমলে ‘অযোগ্য’ ছাপটা পড়িত সব কৃষ্ণাঙ্গের গায়ে, এখন পড়িতেছে দলিতদের গায়ে। আমেরিকার এমআইটি-র শিক্ষক আভা বিজ্ঞানশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলির কাজের ধারা লইয়া গবেষণা করেন। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিশতবর্ষ উদ্্যাপনের অনুষ্ঠানে তাঁহার বক্তব্য, বিজ্ঞানকে নিরপেক্ষ, নৈর্ব্যক্তিক বলিয়া ভাবা হয়। তাই গ্রাম হইতে যে দলিত-আদিবাসী ছেলেমেয়েরা বিজ্ঞান পড়িতে আসেন শহরে, তাঁহারা আন্দাজ করিতে পারেন না কী বৈষম্য, অপমান অপেক্ষা করিতেছে। রোহিতের পূর্বে পদার্থবিদ্যার ছাত্র সেন্থিল কুমারের আত্মহত্যাও মনে করাইয়া দেন তিনি। দলিত ছাত্রছাত্রীদের নানা ভাবে অপদস্থ করিয়া, তাঁহাদের ব্যর্থতাকে প্রায় অবধারিত করিয়া তোলা হয়। কখনও বা অকারণে তাঁহাদের ছাত্রবৃত্তি বন্ধ করিয়া দেওয়া হয়। আইন যে অধিকার দিয়াছে, তাহা কার্যত বাতিল করে প্রতিষ্ঠানগুলি। অধ্যাপক শূরের অভিযোগ, দলিত পড়ুয়াদের হেনস্থা ও বঞ্চনার বহু নজির মিলিয়াছে, কিন্তু শিক্ষাজগৎ বধির, সংস্কারের কোনও দাবি উঠিয়া আসে নাই সেই জগৎ হইতে।

পরাধীন ভারতে কিন্তু শিক্ষকরা এমন ধারণার প্রতিবাদ করিয়াছেন। গণিতজ্ঞ রামানুজনের ব্যর্থতার ব্যাখ্যায় সি ভি রমন বলিয়াছিলেন, স্বেচ্ছাচারী, সহানুভূতিহীন পরীক্ষা ব্যবস্থা রামানুজনের মুখে দরজা বন্ধ করিয়াছে। সেই সময়ে বহু ভারতীয় বিজ্ঞান-ছাত্র মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় হইতে কার্যত বিতাড়িত হন। মেঘনাদ সাহা ইডেন হস্টেল ত্যাগ করিতে বাধ্য হন। প্রফুল্লচন্দ্র রায়, সত্যেন বসু, মেঘনাদ সাহা, ব্রজেন্দ্রনাথ শীল-সহ সে কালের প্রধান শিক্ষাবিদরা তখন সহানুভূতিকে শিক্ষকের একটি প্রধান গুণ বলিয়া নির্দিষ্ট করিয়াছেন। আদর্শ শিক্ষক সমাজ-বিচ্ছিন্ন নহেন, দূরত্ব রাখিয়া চলিবেন না তিনি। দারিদ্র, অস্বাস্থ্য, অপমান, অপরিচিত ভাষার সহিত যুঝিয়া পড়াশোনা করা কত কঠিন, তাহা না বুঝিলে ছাত্রের প্রতি অন্যায় হয়— ঐতিহাসিক নথি হইতে তাঁহাদের সেই সব বক্তব্য উদ্ধৃত করেন আভা শূর।

সব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর এক পাঠক্রম চাপাইলে তাহা শিক্ষার উৎকর্ষকে আঘাত করে। কারণ তাহা ভারতের বৈচিত্রকে নস্যাৎ করে। প্রেসিডেন্সির মঞ্চে এই মত ধ্বনিত হইল সুগত বসুর কন্ঠে। হার্ভার্ডের এই ইতিহাসবিদ মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাতন্ত্র্য অস্বীকার করিয়া এক নিয়মে সব প্রতিষ্ঠানকে টানিয়া আনাকে ‘ঐক্য’ বলিলে ভুল হইবে। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রস্তাবিত ‘এক পাঠক্রম’ তাই ভ্রান্ত। সুগতবাবুর বক্তব্য, সকল বিষয়ে ‘একতা’ চাপাইবার ইচ্ছা প্রায়ই একটা সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ দিয়া চালিত হয়। যাহা অন্য দেশ হইতে স্বদেশকে ভিন্ন, ‘বিশিষ্ট’ বলিয়া দাবি করে। কিন্তু স্বদেশি আন্দোলনের যুগেও স্বদেশিয়ানার যে ধারণা ছিল, তাহা বস্তুত ‘স্বদেশি আন্তর্জাতিকতা।’ জাপান, তুরস্ক, জার্মানি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো নানা দেশের শিক্ষা-সংস্কৃতির সঙ্গে গভীর ভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন রবীন্দ্রনাথ হইতে লালা লাজপত রায়— সে যুগের চিন্তানায়করা। শিক্ষাক্ষেত্রে ন্যায়, বৈচিত্র, স্বাতন্ত্র্য নিশ্চিত না করিলে উৎকর্ষ আসিবে না। ডিরোজিয়োর নামাঙ্কিত প্রেক্ষাগৃহে শিক্ষাবিদরা সে কথাটিই মনে করাইয়া দিলেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE