পশ্চিমবঙ্গ একটি অপারগ রাজ্য বলিয়া পরিচিত। ব্যাকরণ মতে, যে পারে না, সে অপারগ। পশ্চিমবঙ্গের বৈশিষ্ট্য হিসাবে ভূভারতে ইহাই প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে যে, সে পারে না। সমস্ত বিষয়েই ভারতসভায় তাহার স্থান মাঝের সারিতে, অথবা আরও পিছনে। বিশেষ করিয়া অর্থনীতির ভুবনে তাহার জন্য বহু দিন যাবৎ একটি নিদানই বাঁধা: হয় নাই, হয় নাই, ফেল। তাহার সহিত এ কালে যুক্ত হইয়াছে সারদা আদি লগ্নি কেলেঙ্কারির কাহিনি। সর্বশ্রী সুদীপ্ত সেন মহাশয়েরা পশ্চিমবঙ্গের নাম জগৎসভায় পরিচিত করিয়াছেন। দুর্নাম। চন্দ্রশেখর ঘোষকে এই পশ্চিমবঙ্গের অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল। এই পঙ্করাশি হইতেই তিনি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ছাড়পত্র লইয়া প্রকাশ পাইয়াছেন। বন্ধন ফিনানশিয়াল সার্ভিসেস সংস্থার উজ্জ্বল আবির্ভাব সহসা বাঙালিকে গর্ব করিবার একটি যথার্থ হেতু উপহার দিয়াছে। বেসরকারি ব্যাঙ্ক চালু করিবার জন্য পঁচিশটি সংস্থার আবেদন যাচাই করিয়া রিজার্ভ ব্যাঙ্ক প্রথম দফায় দুইটি সংস্থাকে সবুজ সংকেত দেখাইয়াছে, তাহার অন্যতম চন্দ্রশেখর ঘোষের বন্ধন এমন সুসংবাদ পশ্চিমবঙ্গে সুলভ নয়। এই সাফল্য প্রমাণ করিয়াছে, পশ্চিমবঙ্গও পারে। সিপিএমত্ব বা তৃণমূলত্ব বাদ দিয়াই পারে। বন্ধন-এর কৃতিত্ব ভরসা দিয়াছে, শেষ অবধি বাঙালি যদি সফল হয় তবে নিজের জোরেই হইবে, দলীয় পতাকা বা সরকারি বরাভয়ের অবলম্বন ছাড়াই, বিদ্বজ্জনের প্রসাদের অপেক্ষা না করিয়াই। উদ্যোগী বাঙালিই এই রাজ্যের প্রকৃত ভরসা।
চন্দ্রশেখরবাবুর পথে কোনও শর্টকাট ছিল না। আশির দশকে তরুণ বয়সে তিনি পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে কাজ করিয়াছেন, গ্রামীণ অর্থনীতিকে আত্মস্থ করিয়াছেন। বাংলাদেশের প্রসিদ্ধ অসরকারি সংস্থা ব্র্যাক-এর কর্ণধারকে তিনি শিক্ষাগুরুর স্বীকৃতি দিয়াছেন। দুই বঙ্গভাষী ভূখণ্ডের পারস্পরিক লেনদেনের সম্ভাবনা কত দূর, এই কাহিনি তাহারও প্রমাণ। ২০০১ সালে বন্ধন সংস্থার আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠার পরে তাহার অগ্রগতি অনেক দিন অবধি ছিল অত্যন্ত সীমিত। ক্ষুদ্র ঋণ বণ্টনের কারবার প্রসারের পথে বহু বাধা ছিল, প্রধান বাধা ঋণ দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ সংস্থানের। বন্ধনের উদ্যোগীরা দাঁতে দাঁত চাপিয়া সেই সব বাধা অতিক্রমের চেষ্টা করিয়া গিয়াছেন। তাঁহাদের এই সংগ্রাম পর্বতারোহণের শামিল। ক্রমে পথ কিছুটা সহজ হইয়াছে, সাহায্য আসিয়াছে, বিশেষত আই এফ সি এবং সিডবি’র মতো লগ্নি সংস্থা বন্ধনের শেয়ার কিনিয়া তাহাকে আর্থিক সামর্থ্য ও নিরাপত্তা দিয়াছে, বাজারে তাহার মর্যাদাও বাড়াইয়াছে। বাইশটি রাজ্যে সংস্থার কাজ প্রসারিত হইয়াছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের আস্থা বলিয়া দেয়, সেই কাজ নির্ভরযোগ্য ভিতের উপর প্রতিষ্ঠিত।
প্রকৃত উদ্যোগীর পর্বতারোহণ শেষ হয় না। একটি শৃঙ্গ জয়ের পরে নূতন শৃঙ্গের চ্যালেঞ্জ আসে। বন্ধনের সম্মুখে এখন নূতন পরীক্ষা। চন্দ্রশেখরবাবু জানাইয়াছেন, স্বল্প আয়ের গ্রামবাসীদের ঋণ দেওয়ার লক্ষ্যেই তাঁহারা এত দিন কাজ করিয়াছেন, এখন তাঁহাদের ব্যাঙ্কও সেই লক্ষ্যেই অবিচল থাকিবে। কাজটি কঠিন। ব্যাঙ্ক জনসাধারণের নিকট আমানত সংগ্রহ করিতে পারে, সেখানেই তাহার সুবিধা। এবং দায়িত্ব। এই দায়িত্ব যথাযথ ভাবে পালন করিতে পারিলে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ অর্থনীতির বড় উপকার হইবে। কেবল গ্রামীণ সঞ্চয়কে গ্রামীণ উন্নতির কাজে লাগাইয়া যথার্থ ‘ইনক্লুসিভ গ্রোথ’-এর সম্ভাবনা বাড়িবে না, রাজ্যের স্থানীয় অর্থনীতিতে একটি আত্মবিশ্বাস তৈয়ারি হইবে, স্থানীয় সম্পদের সৎ এবং দক্ষ ব্যবহারের পথে স্থানীয় উন্নয়ন যে সম্ভব পশ্চিমবঙ্গের মানুষ তাহা বিশ্বাস করিবার ভরসা পাইবেন। এই রাজ্যে সেই বিশ্বাস ভয়ানক ভাবে আহত হইয়াছে। তাহার শুশ্রূষায় বন্ধনের মতো সংস্থা একটি বড় ভূমিকা লইতে পারে। সত্যই পারিবে কি না, তাহা ভবিষ্যৎই বলিবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy