উ চ্চশিক্ষায় পশ্চিমবঙ্গের অসাফল্যের কাহিনি নূতন নহে। কী ভাবে এই রাজ্যকে আবার শিক্ষার পরিসরে গৌরবের আসন ফিরাইয়া দেওয়া যায়, উৎকৃষ্টি শিক্ষার সন্ধানে ছাত্রছাত্রীদের ক্রমাগত বাহিরে যাইবার ইতিহাস কী ভাবে বিপরীতে ঘোরানো যায়, তাহা লইয়া অনেকেই অনেক কথা বলিয়া আসিতেছেন। বিশেষজ্ঞরাও সেই আলোচনায় বিভিন্ন সময়ে আপন আপন মতামত জানাইয়াছেন। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই জটিলতার মধ্যে যান নাই। তিনি মুশকিল আসানের সহজ পথ বলিয়া দিয়াছেন। তাঁহার সরল অঙ্ক: রাজ্যের ছাত্রছাত্রীরা হার্ভার্ড বা শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িতে যায়, তাহাদের জন্য তিনি রাজ্যেই ভাল ভাল বিশ্ববিদ্যালয় তৈয়ারি করিয়া দিবেন, তাহা হইলেই আর তাহাদের দূরে দূরান্তরে দৌড়াইতে হইবে না, ঘরের ছেলেমেয়ে বইখাতা ও টিফিন কৌটা হাতে ঘরের বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করিতে যাইবে এবং উচ্চশিক্ষিত হইবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়িলেই উচ্চশিক্ষার উন্নতি ঘটিবে, এই ধারণা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই আকাশ হইতে পাড়িয়া আনিলেন, এমন কথা বলিলে ইতিহাসে সহিবে না। এ দেশের রাজনীতিকরা এই ধরনের ভাবনার বশ বলিয়াই দেশ জুড়িয়া এমন বিস্তর কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে, যথার্থ শিক্ষার প্রসারে যাহাদের কোনও ভূমিকাই নাই, কখনও ছিল না, কোনও দিন থাকিবে তাহার ভরসাও নাই। কালক্রমে এই ধারণা জনসমাজেও সঞ্চারিত হইয়াছে, শিক্ষার উৎকর্ষ সম্পর্কে চেতনা ও আগ্রহ যত কমিয়াছে, সেই অনুপাতেই বাড়িয়াছে নিজ নিজ এলাকায় কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় আইআইটি আইআইএম ইত্যাদি প্রতিষ্ঠার দাবি। নির্বাচনী রাজনীতির কারবারিরা সেই দাবি পূরণে কল্পতরু সাজিয়াছেন, এই ধরনের প্রতিষ্ঠানের সংখ্যায় বিস্ফোরণ ঘটিয়াছে, গুণমান সেই অনুপাতে নীচে নামিয়াছে। পশ্চিমবঙ্গেও এই ব্যাধি নূতন নহে। প্রযুক্তিবিদ্যা শিখিতে রাজ্যের ছাত্রছাত্রীদের মহানিষ্ক্রমণ রোধ করিতে শতাব্দীর গোড়ায় বামফ্রন্ট সরকার সহসা রাজ্যে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সংখ্যা বাড়াইতে ব্যগ্র হইয়াছিল, তাহার পরিণাম সর্বজনবিদিত। নূতন বিশ্ববিদ্যালয়ের চাষও বুদ্ধদেববাবুরাই শুরু করিয়াছিলেন। তবে অন্য নানা আগাছার মতোই, তৃণমূল কংগ্রেস আমলে সেটিও উচ্চফলনশীল হইয়াছে। অতএব, বিশ্বভারতীর পাশেই এ বার বিশ্ব বাংলা বিশ্ববিদ্যালয়!
সংখ্যা এবং আড়ম্বরের মোহ ছাড়িয়া মুখ্যমন্ত্রী যদি উচ্চশিক্ষার প্রসারে সত্যই মন দিতে চাহেন, তবে অবিলম্বে একটি কাজ করুন। যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি রাজ্যে আছে, তাহাদের আগামী দশ বছরের একটি পরিকল্পনা করিতে বলুন। লোকদেখানো পরিকল্পনা নহে, যথার্থ আত্মসমীক্ষার ভিত্তিতে সম্ভাবনা যাচাই করা আবশ্যক। প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়গুলি আপাতত নিজেদের মতো ভাবুক, কিন্তু রাজ্য সরকারের অধীন অর্বাচীন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা কম নহে, তাহাদের দিনগত পাপক্ষয় বন্ধ করা আবশ্যক। উচ্চ মানের শিক্ষক এবং প্রয়োজনীয় গবেষণাগার ও অন্যান্য পরিকাঠামো কাহার কয় আনা আছে, কোন বিষয়েই বা কতখানি আছে, সেই হিসাব কষিয়া ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা রচনা করা দরকার, অন্য উপায় নাই। সম্ভবত সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত বিভাগ চালু রাখিবারও সুযুক্তি নাই, কারণ তাহাদের সেই সামর্থ্যই নাই। সুতরাং কঠোর এবং অপ্রিয় অনেক সিদ্ধান্ত লইতে হইবে। মুখ্যমন্ত্রী পারিবেন কি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy