Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

ভয়

আরও একটি দ্রুতগামী গাড়ি ফুটপাথের ধারে ঘুমাইয়া থাকা মানুষকে পিষ্ট করিল। অভিযোগ— আরও এক বার সেই গাড়ির চালকের আসনে ছিলেন কোনও এক প্রভাবশালী পিতার পুত্র।

শেষ আপডেট: ১০ জানুয়ারি ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

আরও একটি দ্রুতগামী গাড়ি ফুটপাথের ধারে ঘুমাইয়া থাকা মানুষকে পিষ্ট করিল। অভিযোগ— আরও এক বার সেই গাড়ির চালকের আসনে ছিলেন কোনও এক প্রভাবশালী পিতার পুত্র। আরও এক বার তাঁহারা মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালাইতেছিলেন। কুনাট্যটি ভারতে ইতিপূর্বেই এত বার মঞ্চস্থ হইয়াছে যে লখনউ-এর হজরতগঞ্জে ঘটা সাম্প্রতিকতম কাণ্ডটি সম্পর্কে আর নূতন কিছু বলিবার থাকিতে পারে না। গাড়ির চালক এক প্রাক্তন বিধায়কের পুত্র। পথের ধারে অস্থায়ী ছাউনিতে থাকা মানুষগুলি নেহাত খাটিয়া খাওয়া। কিন্তু একটি পুরাতন কথা আরও এক বার বলা প্রয়োজন। বস্তুত, কথাটির এত পুনরাবৃত্তি প্রয়োজন, যেন তাহা ভারতের নাগরিক সমাজের চেতনার অন্তর্ভুক্ত হইয়া যায়।

কথাটি সহজ— কেহ মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালাইলে তাহার কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করিতে হইবে। এক্ষণে প্রশ্ন উঠিবে, শাস্তির ব্যবস্থা করিবে কে? যাঁহারা আইন রচনার অধিকারী, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মদ্যপ চালকরা তাঁহাদের ঘনিষ্ঠ জন। এবং, পথের ধারে যাঁহারা মারা যান, তাঁহারা ‘অপর’। যাঁহারা ফুটপাথে, অথবা রাস্তার ধারে ত্রিপলের ছাউনির নীচে রাত কাটাইতে বাধ্য হন, তাঁহারা সমাজের যে নীচতলার মানুষ, ক্ষমতাবানদের দৃষ্টি সচরাচর সেই অতলে পৌঁছায় না। অতএব, তাঁহাদের প্রতি ঘটা অন্যায়ের প্রতিকার করিতে, অথবা তাঁহাদের জীবনের এই নিরাপত্তাটুকু নিশ্চিত করিতে ক্ষমতাবানরা ‘স্বজন’-এর অসুবিধা সৃষ্টি করিবেন কেন? এই প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করিতে হইলে শাস্তির দাবিটিকে নাগরিক চেতনার অন্তর্ভুক্ত না করিয়া উপায় নাই। এই দাবিটি না মানা যে ‘অবৈধ’, সেই কথাটিকে প্রতিষ্ঠা করিতে পারে রাজনীতি। ক্ষমতাবানদের উপর চাপ তৈরি করিবার রাজনীতি। সেই কারণেই দাবিটির পুনরাবৃত্তি প্রয়োজন। যত ক্ষণ না দাবিটি স্বীকৃত হইতেছে, তত ক্ষণ।

মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালাইলেই যে চালকরা মানুষ মারেন না, তাহাতে সংশয় নাই। বস্তুত, অবস্থাপন্ন শহুরে ভারতীয়দের মধ্যে ‘পৌরুষ’-এর একটি প্রতীক হইল মদ্যপান করিয়া যথাযথ গাড়ি চালাইতে পারা। যিনি যত ভাল পারেন, তিনি তত বেশি ‘পুরুষ’। তবে, সেই ‘পুরুষ’-দের প্রত্যেকেই সম্ভাব্য ঘাতক। কোনও এক দিন তাঁহাদের অতি দ্রুত ধাবমান গাড়ির চাকা ফুটপাথে উঠিয়া পড়িবে না, স্বয়ং বিধাতাও সেই নিশ্চয়তা দিবেন না। কাজেই, মানুষ মারিবার পর গ্রেফতার করিয়া শাস্তি দেওয়া যেমন জরুরি, আরও অনেক বেশি জরুরি এই প্রবণতার মূলে আঘাত করা। তাহার একমাত্র পথ, নেশাগ্রস্ত অবস্থায় গাড়ি চালানো বন্ধ করা। তাহার জন্য প্রচার চলুক, কিন্তু শুধু কথায় যে এই কাজ হইবে না, তাহাতে সংশয়ের লেশমাত্র নাই। কঠোর শাস্তিই উপায়। তাহার জন্য প্রতিটি গাড়ি থামাইয়া নজরদারি করিবার প্রয়োজন নাই। পুলিশ নিয়মিত কিছু গাড়ি ধরুক। চালক নেশাচ্ছন্ন কি না, সেই পরীক্ষা হউক। ধরা পড়িলে এমন কঠিন শাস্তি হউক, যেন তাহা অন্যদের মনেও ভয়ের সঞ্চার করে। প্রথম বারেই লাইসেন্স বাতিল করিয়া দেওয়া হউক, মোটা টাকা জরিমানাও হউক। আক্ষরিক অর্থেই যেন এই শাস্তি দৃষ্টান্তমূলক হয়। শাস্তির সম্ভাবনা কার্যত না থাকায় যে অপরাধের বাড়বাড়ন্ত হইয়াছে, কঠোর শাস্তির ভয় তৈরি হইলে প্রবণতাটি কমিবেও বটে। তবে, অপরাধী ধরা পড়া মাত্রেই ‘ফোন’ আসিবার খেলাটিও বন্ধ করিতে হইবে। রাজনীতির দাবি ততখানিই হওয়া বিধেয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE