ভাল কাজ ভাল মনে করিতে হয়। আসিয়ান-এর সহিত একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করিয়া কেন্দ্রীয় বাণিজ্য মন্ত্রী নির্মলা সীতারামন বলিয়াছেন: এই চুক্তিতে ভারতের স্বাক্ষর করিতেই হইত। নূতন সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রীর আসনে বসিয়া তিনি আগেও মন্তব্য করিয়াছেন, বিভিন্ন মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি হইতে কতটা কী লাভ হয়, তাহা বিচার করিয়া দেখা দরকার। বিচারশীলতা মানুষের ধর্ম, আরিস্ততল বলিয়া গিয়াছেন। কিন্তু মন্ত্রিমহোদয়ার এই সব উক্তিতে একটি মানসিকতার ছায়া পড়ে, যাহা উদ্বেগজনক। বাণিজ্যের মুক্তি নীতি এবং আদর্শের মাপকাঠিতে সমর্থনযোগ্য, কারণ তাহা যথার্থ দক্ষতার অনুকূল, যে দক্ষতা একটি দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের মজবুত ভিত্তি রচনা করিতে পারে, কারণ সেই ভিত্তিতে দাঁড়াইয়া প্রতিযোগিতার মোকাবিলা করা যায়। যে যথেষ্ট দক্ষ নহে, তাহার পক্ষে মুক্ত বাণিজ্য সমস্যার কারণ হইতে পারে, কারণ প্রতিযোগিতায় আঁটিয়া উঠিবার সামর্থ্য তাহার নাই। এই কারণেই বিভিন্ন স্বার্থগোষ্ঠী মুক্ত বাণিজ্যের বিপক্ষে সওয়াল করিয়া থাকে। উন্নত দুনিয়াতেও তেমন স্বার্থগোষ্ঠী বিস্তর রহিয়াছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভারত ও অন্যান্য দেশের তথ্যপ্রযুক্তি কর্মীদের কাজ দেওয়া, বিশেষত আউটসোর্সিং বা কাজ-চালানের বিরুদ্ধে গোষ্ঠীস্বার্থ-চালিত সওয়াল ও মার্কিন কংগ্রেস হইতে হোয়াইট হাউস অবধি তাহার উৎকট প্রভাবের সাম্প্রতিক ইতিহাস স্মরণীয়। ভারতে খুচরো বাণিজ্যে বিদেশি বিনিয়োগ প্রতিহত করিতে জোরদার রাজনৈতিক তৎপরতার পিছনেও স্থিতাবস্থার চাপ সক্রিয়। লক্ষণীয়, এই প্রতিরোধে বিজেপি অগ্রণী ভূমিকা লইয়াছে। নরেন্দ্র মোদী অর্থনীতির মুক্তির পক্ষে সওয়াল করিলেও তাঁহার দল সেই মুক্তি কত দূর মানিতে চাহে, বাণিজ্য মন্ত্রীর মন্তব্য সেই সংশয়কে জোরদার করিয়াছে।
আসিয়ান পূর্ব তথা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দশটি দেশের গোষ্ঠী। অর্থনীতি এবং বাণিজ্যের অগ্রগতিতে এই গোষ্ঠীর ওজন ক্রমশ বাড়িতেছে। ভারতের সহিত এই গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলির বাণিজ্য আগামী বছরে একশো বিলিয়ন অর্থাৎ দশ হাজার কোটি ডলারে পৌঁছাইবার লক্ষ্য নির্ধারিত হইয়াছে। পণ্য ও পরিষেবার উৎপাদনে এই দেশগুলির দক্ষতা স্বীকৃত। স্বভাবতই ইহাদের সহিত অবাধ লেনদেন ভারতের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের পক্ষে ভাল। ২০০৯ সালে এই গোষ্ঠীর সহিত পণ্য বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভারত একটি চুক্তি স্বাক্ষর করিয়াছিল। তখনও বাধা আসিয়াছিল, কিন্তু বহুনিন্দিত ইউপিএ সরকার সেই বাধা ঠেলিয়া মুক্ত বাণিজ্যের পথে অগ্রসর হইয়াছিল। তাহার ফলে ভারতের উপকার খুব বেশি হয় নাই, কিন্তু তাহা মুক্ত বাণিজ্যের অপরাধ নহে, ঘটনা ইহাই যে, পণ্য উৎপাদনে ভারতের দক্ষতা কম, প্রতিযোগিতার সাধ্য সীমিত।
এ বার মুক্ত বাণিজ্যের চুক্তি হইয়াছে পরিষেবা এবং বিনিয়োগের ক্ষেত্রে। এই চুক্তি কার্যকর হইলে বিশেষ উপকার হইবে তথ্যপ্রযুক্তি পরিষেবার ক্ষেত্রে কর্মরত সংস্থা ও কর্মীদের, রফতানি এবং কর্মসংস্থানের প্রসার ঘটিবে, কারণ এই ক্ষেত্রটিতে ভারতের দক্ষতা এবং সামর্থ্য পণ্য উৎপাদনের তুলনায় অনেক বেশি। কিন্তু কী পণ্য, কী পরিষেবা, উভয় ক্ষেত্রেই দক্ষতা পরিবর্তনশীল। শিল্প অথবা পরিষেবা নয়, শিল্প এবং পরিষেবা, উভয় ক্ষেত্রেই ভারতীয় অর্থনীতির দক্ষতা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার উপযোগী স্তরে উন্নীত করা জরুরি। প্রধানমন্ত্রী দুনিয়ার পণ্য উৎপাদনকারী সংস্থাগুলিকে ‘ভারতে উৎপাদন’ করিবার যে আহ্বান জানাইয়াছেন, অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির দক্ষতা না বাড়িলে তাহা ফাঁকা আওয়াজই থাকিয়া যাইবে। মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি জরুরি, কিন্তু যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন যথার্থ মুক্ত অর্থনীতির। ‘অগত্যা মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিতে সই করিতেছি’ ভাবিবার মানসিকতা মুক্ত অর্থনীতির অনুকূল নহে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy