Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

অতীতচারিতা

ভারতীয় ইতিহাস গবেষণা পরিষদের সভাপতি পদে নিযুক্ত ওয়াই সুদর্শন রাওয়ের ধারাবাহিক সুভাষিতাবলি চিন্তার কারণ হইয়া উঠিতেছে। তিনি রামায়ণ-মহাভারতের গল্পকে ‘প্রামাণ্য ইতিহাস’ এবং ‘সত্য ঘটনার তথ্যনিষ্ঠ বিবরণী’ বলিয়া মান্য করেন। তাঁহার মতে, কেবল পাথুরে প্রমাণই ঐতিহাসিকতা প্রতিপন্ন করে না। তা ছাড়া, আধুনিক ইতিহাস ও তাহার রচনাশৈলীর জন্মের অনেক পূর্বেই অযোধ্যার জন্ম।

শেষ আপডেট: ১৬ জুলাই ২০১৪ ০০:০১
Share: Save:

ভারতীয় ইতিহাস গবেষণা পরিষদের সভাপতি পদে নিযুক্ত ওয়াই সুদর্শন রাওয়ের ধারাবাহিক সুভাষিতাবলি চিন্তার কারণ হইয়া উঠিতেছে। তিনি রামায়ণ-মহাভারতের গল্পকে ‘প্রামাণ্য ইতিহাস’ এবং ‘সত্য ঘটনার তথ্যনিষ্ঠ বিবরণী’ বলিয়া মান্য করেন। তাঁহার মতে, কেবল পাথুরে প্রমাণই ঐতিহাসিকতা প্রতিপন্ন করে না। তা ছাড়া, আধুনিক ইতিহাস ও তাহার রচনাশৈলীর জন্মের অনেক পূর্বেই অযোধ্যার জন্ম। তাই রামজন্মভূমি হিসাবে অযোধ্যার ঐতিহাসিকতা বিষয়ে ইতিহাস কেমন করিয়া কথা বলিবে? শুধু তাহাই নহে, প্রাচীন বর্ণব্যবস্থাকে তিনি মোক্ষলাভের উপায় বলিয়া গণ্য করেন এবং পরবর্তী কালের জাতিভেদপ্রথাকেও সভ্যতার প্রয়োজন অনুসারে বিবর্তিত প্রথা হিসাবে গণ্য করেন, ধর্মশাস্ত্রের অপব্যাখ্যায় যাহার বদনাম হইয়াছে। এই ইতিহাসবীক্ষা এ দেশে নূতন নহে। একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকেও এমন ‘দর্শন’ সনাতন ভারতের সনাতনত্বেরই প্রমাণ। এই দেশে সমস্ত প্রাচীন এবং ভ্রান্ত মতই গোময় এবং গোমূত্র সমেত দিব্য বাঁচিয়া থাকে, খুঁজিলে হয়তো সতীদাহের সমর্থকও মিলিবে।

কিন্তু সুদর্শন রাওয়ের ব্যক্তিগত অভিমত এ ক্ষেত্রে গৌণ। আশঙ্কার মূল কারণ, তাঁহার এই অভিমত কি অতঃপর ইতিহাস গবেষণার সরকারি কর্মকাণ্ডকেও প্রভাবিত করিবে? কেবল ইতিহাস গবেষণা পরিষদ নয়, আশঙ্কা হয়, অতঃপর পাঠ্যক্রম নির্ণয়ের ভারপ্রাপ্ত এনসিইআরটি, ভারতীয় সমাজবিজ্ঞান গবেষণা পর্ষদ, ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্সড স্টাডিজ এবং ইউজিসি-র মতো প্রতিষ্ঠানেও সুদর্শন রাওয়ের মতো বিদ্বানরাই অভিষিক্ত হইবেন। বিজেপি পরিচালিত পূর্বতন এনডিএ সরকারের আমলেও মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী মুরলীমনোহর জোশীর পৌরোহিত্যে এই সব প্রতিষ্ঠানে হরি গৌতম-এর মতো বিদ্বজ্জনরা নিযুক্ত হন, যাঁহারা জ্যোতিষ শাস্ত্র, বৈদিক গণিত ও জ্যোতিষ এবং হিন্দু কর্মকাণ্ড ও আচার লইয়া রীতিমত পাঠ্যক্রম চালু করিয়াছিলেন। শিক্ষায় এই উল্টোরথের যুক্তি হিসাবে সনাতন ভারতীয় সভ্যতা-সংস্কৃতির নিরবচ্ছিন্নতার ধুয়া তোলা হইয়াছে, যাহা ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ার দায় সাতশো বছরের ‘অন্ধকারাচ্ছন্ন’ মুসলিম শাসনের ঘাড়ে চাপানো হইয়াছে।

সনাতন ভারতের প্রবক্তারা জাতপাতকে মহিমান্বিত করিয়া, পুরাণ-মহাকাব্যকে ইতিহাসের মর্যাদা দিয়া, ধর্মীয় রীতিনীতিকে অপরাবিদ্যার গরিমা প্রদান করিয়া এবং প্রতিক্রিয়াশীল পিতৃতন্ত্রের বন্দনা গাহিয়া সনাতন ভারতের পুনরুজ্জীবনে আগ্রহী। কিন্তু তাঁহাদের কল্পনার সনাতন ভারত বহু কাল বিগত, নিঃশেষিত। নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁহার সহকর্মীদের স্থির করিতে হইবে, তাঁহারা সেই মান্ধাতার আমলকে ফিরাইয়া আনিতে চাহেন, না কি বিশ্বায়িত অর্থনীতি এবং সংস্কৃতির যথার্থ অংশীদার এক নূতন ভারত গড়িবার কাজটিকেই অগ্রবর্তী করিতে চাহেন। যদি যথার্থ উন্নয়ন তাঁহাদের লক্ষ্য হয়, তবে সুদর্শন-মার্কা উদ্ভট এবং ভ্রান্ত প্রাচীনতার মোহ সম্পূর্ণ বিসর্জন দিতে হইবে। চণ্ডীমণ্ডপে বসিয়া আধুনিক ভারত গড়া যায় না। বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে নূতন কর্ণধার নিয়োগ হইতেছে, হইবে। স্বাভাবিক। কিন্তু কাহারা নিযুক্ত হইবেন, সেই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী তথা তাঁহার সরকারের বিশেষ ভাবে সচেতন থাকা দরকার। তাহা না হইলে পুরাতন আসিয়া নূতনকে গ্রাস করিয়া লইয়া যাইবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

editorial
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE