উত্তরবঙ্গে এনসেফ্যালাইটিস মহামারির আকার ধারণ করার পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পত্রপাঠ রাজধানী কলিকাতাকে ওই মারণ রোগের আশঙ্কামুক্ত করিতে শহরময় শূকর ধরার এবং তাহাদের স্থানান্তরিত করার নির্দেশ দিয়াছেন। শহর জুড়িয়া শূকর ধরার হিড়িক পড়িয়া গিয়াছে। পুরসভা ও তাহার কর্মচারীরা অবশ্য তাহা করিতে গিয়া রীতিমত হিমশিম খাইতেছেন। তাঁহাদের যুদ্ধকালীন তত্পরতাকে উপহাস করিয়া শূকরের পাল পিছলাইয়া এদিক-ওদিক পালাইতেছে। সরকারের স্থানান্তরিত প্রশাসনিক কেন্দ্র হাওড়ায় তো পুরসভা শূকরদের প্রায় জামাই-আদরে রাখিবার বন্দোবস্ত করিয়া মশারি, মশা-মারার ধোঁয়া, সিসিটিভি ইত্যাদি সংগ্রহ করিতেছে। মশারি যাহাতে শূকরদের মশা না কামড়ায়, আর সিসিটিভি যাহাতে পলায়নপর হইলে তাহাদের উপর নজর রাখা যায়। এতখানি দরদ হাওড়া পুরসভা তাহার নাগরিকদের জন্য কখনও দেখাইয়াছে বলিয়া মনে পড়ে না। সব মিলাইয়া এ এক আজব সার্কাস।
সমগ্র কুনাট্যটি যে নিগূঢ় প্রশ্ন তুলিয়া ধরিয়াছে, তাহা হইল, শহরের ভিতর শূকর আদৌ ছিল কেন? কলিকাতাকে অনেকেই পরিহাসছলে মহানগরীর বদলে মহাগ্রাম বলিয়া থাকেন। এখানকার অনেক কিছুই গ্রামীণ চণ্ডীমণ্ডপকে মনে পড়ায়। তাই বলিয়া শহরের যত্র-তত্র শূকরের পাল ছানাপোনাদের লইয়া আনাচেকানাচে বিচরণ করিয়া ফিরিবে, এমনকী হাসপাতালেও দাপাইয়া বেড়াইবে? কলিকাতা কি একটি পরিকীর্ণ খোঁয়াড়? বস্তুত, নগর যে নাগরিকদের জন্য, শূকরদের জন্য নয়, ইহা বুঝিতে মন্ত্রী, পুরকর্তা কিংবা স্বাস্থ্য দফতরের আধিকারিক হইতে হয় না। সাধারণ বুদ্ধিই বলিয়া দেয়, কোনও আধুনিক শহরেই একটি শূকরও থাকা উচিত নয়। দুর্ভাগ্যবশত কলিকাতা ও রাজ্যের সর্বংসহ নাগরিকরা এই প্রশ্নে অদ্যাবধি কোনও আন্দোলন করেন নাই। সরকার ও তাহার প্রশাসনও তাই বিষয়টি উপেক্ষা করার সাহস পাইয়াছে।
এনসেফ্যালাইটিস-বাহী মশককুল যে কেবল শূকরদেহ হইতেই ওই মারণজীবাণু সংগ্রহ করে, এমন নয়। যাবতীয় গবাদি পশুই তাহার উত্সস্থল। এ জন্যই কলিকাতাকে একদা খাটালশূন্য করার অভিযান চালানো হইয়াছিল। তাহার পর বেশ কিছু কাল উত্তীর্ণ। মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং জানাইয়াছেন, শহরে গরু-মহিষ আর নাই। তথ্যটি ভ্রান্ত। লেক গার্ডেন্স, অরফানগঞ্জ বাজার, হেস্টিংস, খিদিরপুর সহ কলিকাতার সর্বত্র ছোট-বড় খাটাল নিত্য টাটকা দুধের সন্ধানী গৃহস্থদের চাহিদা মিটাইয়া থাকে। অথচ মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁহার প্রতিধ্বনি করিয়া কলিকাতা পুর কর্তৃপক্ষ বলিতেছেন, ‘খাতায়-কলমে শহরে কোনও খাটাল নাই’। সংবাদপত্রে খাটালের সচিত্র বিবরণকে হয়তো অতঃপর ‘সাজানো ঘটনা’ বলা হইবে। অথচ ইতস্তত বিচরণশীল শূকরবাহিনীর পাশাপাশি এই সব খাটালকেও অবিলম্বে উচ্ছেদ করা প্রয়োজন। এনসেফ্যালাইটিসের প্রকোপকে লঘু করিয়া দেখাইতে চাহিলে অবশ্য এ সব কিছুই করার দরকার নাই। মহাগ্রাম কলিকাতা সে ক্ষেত্রে এনসেফ্যালাইটিস, ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গির পসরা সাজাইয়া ‘বিশ্ববাংলা’কে আহ্বান করিবে। ‘রেতে মশা, দিনে মাছি/ এই নিয়ে কলকেতায় আছি’ গুপ্তকবির এই দেড়শতাধিক বত্সর পূর্বের আক্ষেপ লইয়া বঙ্গবাসী না-হয় এই একুশ শতকেও আনন্দে ঘর করিলেন!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy